বাংলাদেশের মোহনা, মোহনার বাংলাদেশে

মোহনা রেজা ও মাশরুর শাকিল
মোহনা রেজা ও মাশরুর শাকিল  © টিডিসি ফটো

মোহনার সাথে আমার প্রথম দেখা বাংলাদেশে। তার সাথে পূর্ণ পরিচয়-আলাপ ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে। সময়টা ২০১৯ সাল। সেবার আমি ইংল্যান্ড সরকারের মর্যাদাপূর্ণ 'শিভনিং সাউথ এশিয়ান জার্নালিজম ফেলোশিপ' সম্পন্ন করতে দুইমাসের জন্য ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে গিয়েছিলাম। মোহনা তখন গ্রেট ব্রিটেনের আরেক রাজ্য স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিদ্যায় উচ্চতর পড়াশোনা করছে।

আমাদের সাক্ষাত ও আলাপের পর্বটা হয়েছিল লন্ডনের বাণিজ্যিকভাবে ব্যস্ততম এলাকা কেনারি ওয়ারফের টেমস নদীর পাড়ে। 

মোহনা এডিনবরা থেকে লন্ডনে আসলে এক শুভ বিকেলে আমাদের টানা দুইঘণ্টার ঐতিহাসিক বৈকালিক আড্ডা হয়। লন্ডনের ক্যানারি ওয়ারফ আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বের হলেই একদিকে বিশ্বখ্যাত নিউজ এজেন্সি রয়টার্সের অফিস, অন্যদিকে বাণিজ্যিকভাবে খ্যাত আইবিএমসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের সুউচ্চ দালান।

বিকেলে আমি যখন ক্যানারি ওয়ারফে পৌঁছায় তখন লন্ডনের মার্কামারা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। মোহনাই আমাকে ছাতা এগিয়ে দিয়ে রিসিভ করেছিল।

আমরা দুজন টেমস নদীর পাড় ধরে কিছুদুর হাটি। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে বসি। আলাপে আলাপে মোহনা যখন আমাকে জানায়, সে  ক্লাসের ফাঁকে ছুটির দিনগুলোতে আর্কিটেকচ্যারাল ট্যুর গাইডিং করে। আমি খুব অবাক হয়ে যাই। সাধারণত আমাদের দেশের ধনী পরিবারেরব বেশিরভাগ সন্তানেরা বিদেশে গিয়ে নামমাত্র পড়াশুনা করে আর বাকি সময় আয়েশি জীবনযাপন করে হইহুল্লোড় করে সময় কাটায়। বিপদগামী হয়ে গোল্লায় যাওয়ার উদাহরণ ভুরি ভুরি।

সেখানে মোহনা গুলশান-বনানীর বিত্তবান পরিবারে বেড়ে ওঠা একজন মেয়ে হয়েও সাধারণ একজন শিক্ষার্থীর মত তার ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরিয়ে দেখিয়ে স্থাপত্যকীর্তির বর্ণনা দিচ্ছেন! আমি উপলব্ধি করতে পারি এ কন্যা অন্য ধাতুতে গড়া।

আমাদের আড্ডায় একবারও আমাদের পারিবারিক পরিচয়, তার পিতার সাথে আমার কর্ম-সম্পর্ক, বাংলাদেশে আমার-তার অবস্থান কিছুই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বলা যায় মনেই পড়েনি। এই সাবলীলতার কৃতিত্ব যতটা না আমার তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মোহনার উদারতা ও হাস্যজ্জল আন্তরিকতার। 

আমাদের দেশের অর্থবানদের সন্তানরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যখন তার চেয়ে কম অর্থবান কারও সাথে আলাপ করেন তখন তার চেয়ে তার ধনী পিতার অর্থের ঝনঝননী অনেক বেশি কানে বাজে। মোহনা এক্ষেত্রে একেবারে ব্যতিক্রম। প্রথম সাক্ষাত হলেও আমার একবারের জন্য মনে হয়নি আমি বাংলাদেশের কোন মিডিয়া মুঘলের মেয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছি; যার পিতা আবার আমার নিয়োগকর্তা।

দু’ঘণ্টার আলাপে মোহনা তার এডিনবরার উচ্চতর পড়াশোনার জীবন, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, বাংলাদেশের স্থাপত্য চর্চার বিবর্তন নিয়ে তার গবেষণা, স্থাপত্য বিদ্যায় তার স্বপ্ন, ডক্টরেট করে তার দেশে ফিরে আসা, নিজ বিয়ে পরিকল্পনা সব কিছু নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছিল।

শুধু কি তাই ওইদিনের সুস্বাদু ও দামি মাশরুম পিজার বিল প্রদানের ক্ষেত্রেও সে আমাকে সম্মানিত করেছে। আমি যখন তাকে বলেছি এই বিল আমি দেব কারণ আমার এই পাউন্ড ব্রিটিশ সরকারের স্কলারশিপে পাওয়া এবং  তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে বিল দেয়ার সুযোগ দিয়ে বাধিত করতে পার। মোহনা মুচকি হেসে না করেনি।

অবশ্য আমরা সেই সন্ধ্যায় একটি জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট করেছিলাম। কথা ছিল লন্ডনে ফেলোশিপ সম্পন্ন করার পর আমি তার অতিথি  হয়ে এডিনবরায় বেড়াতে যাব। সময়ের সীমাবদ্ধতায় সেবার আমি স্কটল্যান্ড গেলেও তার নিমন্ত্রণ গ্রহণে সুযোগ হয়নি। এডিনবরার পাশের শহর ডান্ডি পর্যন্ত গিয়ে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।   এডিনবরার সেই ডিনার এখনো অপেক্ষায় আছে।

মোহনা রেজা এখন ডক্টর মোহনা রেজা। স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব স্থাপত্য কাঠামোর বিবর্তন' নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, স্কটিশ বা ব্রিটিশ জীবনের মিথ্যা মায়া ত্যাগ করে দেশে ফিরে এসেছে। সে তার প্রিয় আপু উপন্যাসিক রাবেয়া খাতুনের প্রিয় দেশ, তার বাবা ফরিদুর রেজা সাগরের প্রিয় জন্মভুমি, তার মা কনা রেজার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।
 
ডক্টর মোহনার কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু পাওয়ার আছে। তারও তার প্রিয় দেশকে, দেশের মানুষকে অনেক কিছু দেয়ার সুযোগ আছে। তার সেই মানসিকতা যেমন আছে সক্ষমতাও আছে। এখানেই আমার আমাদের সবার প্রত্যাশা- মোহনা, তুমি দুর্বল চিত্তের দেশীয় ধনবানদের সেইসব দুধে-ভাতের সন্তানদের মত পান থেকে চুন খসলে দেশকে একচোট গালি দিয়ে তথাকথিত উন্নত দেশে পাড়ি দিও না।

দেশের প্রতি বিশ্বাস রাখো। যে বিশ্বাসে তোমার দিদা, তোমার বাবা, তোমার মা—তোমাকে বড় করেছে। দেখো এদেশে পদ্মা সেতু হয়েছে, মেট্রোরেল হয়েছে, উন্নত দেশের পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।  
তুমি বাংলাদেশের মোহনা, এসো উন্নয়নের মোহনায় মিলিত হই।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল আই


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence