কওমি মাদ্রাসায় নির্যাতনের ‘বেশিরভাগই ধামাচাপা পড়ে যায়’

  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটানো এবং যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বার বার উঠে এলেও এসব নির্যাতন বন্ধে কার্যত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। সম্প্রতি ৮ বছর বয়সী এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে পেটানোর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে বিষয়টি আবার নতুন করে সামনে আসে।

মূলত মানুষের দানে পরিচালিত এই কওমি মাদ্রাসাগুলোয় সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন না হওয়াকে চলমান নির্যাতনের বড় কারণ বলে মনে করছে শিশু অধিকার ফোরাম। যদিও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বলছে আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও এখন আর তেমনটা ঘটছে না।

পান থেকে চুন খসলেই নির্যাতনে খড়গ

হাসান ওয়ালি ঢাকার একটি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে সম্প্রতি দাখিল পাস করেছেন। শিশু বয়সে প্রায় পাঁচ বছরের মতো তিনি মক্তব, হেফজখানা ও কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ওই কয়েক বছরে পান থেকে চুন খসলেই মাদ্রাসা শিক্ষকদের চরম মারধরের শিকার হয়েছেন তিনি ও তার সহপাঠীরা।

বুকে লাথি দিয়ে, মাটিতে আছড়ে ফেলে বেত দিয়ে তাদের এতো জোরে পেটানো হতো যে অনেক ছাত্র ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারাতেন। মাদ্রাসায় এসব নির্যাতনের কারণে অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ পড়েছেন বলেও তিনি জানান। ওয়ালি বলেন, কওমি মাদ্রাসাগুলোয় মারধরের বিষয়টি খুব স্বাভাবিক হওয়ায় সন্তানদের সেই মানসিক প্রস্তুতি দিয়েই অভিভাবকরা সেখানে পড়াতে পাঠান।

আবার অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর বিকল্প উপায় না থাকায় এক প্রকার নীরবেই এই নির্যাতনের বিষয়গুলো তারা মেনে নেন।

হাসান ওয়ালি বলেন, আমার সহপাঠীদের অনেকে তাদের মা বাবাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানালেও তারা সেটাকে কোন গুরুত্বই দেয় না। কারণ হুজুররাই বলতেন যে হুজুররা মারলে যে দাগ হয় সেটা দোজখে পোড়ে না। ওই বিশ্বাস থেকে, আবার হুজুরের কাছে জবাবদিহিতা চাইলে তারা ছেলে বদদোয়া দিতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই চুপ থাকেন।

কওমি মাদ্রাসার দুজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাদেরকে একই ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। শৌচগারের যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। পড়ার বাইরে বাকি সময়ে হুজুরদের কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানোসহ নানা কাজ করতে হয় তাদের।

বিশ্রাম, ঘুম, খেলাধুলা এমনকি মা বাবার সাথে নিয়মিত কথা বলার নূন্যতম সুযোগও তাদের থাকে না। এছাড়া নির্যাতনের শিকার হলেও পরকালের ভয় দেখিয়ে তাদের মুখবন্ধ রাখা হতো।

নির্যাতনের পেছনে কারণ কী

কওমি মাদ্রাসায় শিশুদের পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে দেয়া, যৌন নির্যাতন, এমনকি হত্যার ঘটনা এর আগেও বহুবার গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এলেও, এসব নির্যাতন বন্ধে কার্যত কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

যেসব ঘটনা সামনে আসছে তার তুলনায় ‘প্রকৃত নির্যাতনের ঘটনা কয়েকগুণ বেশি যার বেশিরভাগই ধামাচাপা পড়ে যায়’ বলে জানান বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস শহীদ। অথচ বাংলাদেশে শিশু আইনে স্পষ্ট বলা আছে যে শিশুকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত বা অবহেলা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

শিশু আইন অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বে বা পরিচর্যায় থাকা কোন শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ, ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে ব্যবহার বা অশালীনভাবে প্রদর্শন করে এবং এর ফলে ওই শিশুর যদি দুর্ভোগ হয়, শিশুর শারীরিক ক্ষতি বা মানসিক বিকৃতি ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি আইনের অধীনে অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং ওই অপরাধের জন্য তাকে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

শহীদ মনে করেন, প্রশাসনের উদাসীনতা, অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং মানুষের দানে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকা কওমি মাদ্রাসায় নির্যাতনের বড় কারণ।

তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসায় সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি আছে কিনা আমার খুব সন্দেহ আছে। সরকারের দায়িত্বে যারা আছেন তারা এর দায়ভার এড়াতে পারেন না। এজন্য আইন প্রয়োগ করে দোষীদের দ্রুত কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অভিভাবকরা মামলা না করলে সরকার বা পুলিশকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে।

‘নির্যাতন বন্ধে জিরো টলারেন্সে আছি’

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কওমি মাদ্রাসা মূলত বেফাকুল মাদরিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ বা বেফাক বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আছে। ওই বোর্ডের এক কর্মকর্তা আবু বকর ইউসূফি জানিয়েছেন যে, এর আগে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এখন আর তেমন হয় না।

তারপরও যে ক’টি ঘটনা ঘটছে সেগুলো প্রতিরোধে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা জানান তিনি। এরিমধ্যে কওমি মাদ্রাসাগুলোয় বেতের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোন শিক্ষার্থী অপরাধ করলে তাকে নির্যাতন ছাড়া কীভাবে শাসন করা যাবে সেই পদ্ধতির ব্যাপারেও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এছাড়া অভিভাবকদের বলা হচ্ছে তারা যেন সন্তানদের জোর করে না পাঠিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তবেই মাদ্রাসায় পাঠান।

আবু বকর ইউসূফি বলেন, আমরা মাদ্রাসাগুলোয় শিশু নির্যাতন বন্ধে জিরো টলারেন্সে আছি। আগের চাইতে এখন ঘটনা অনেক কমেছে। তারপরও দুই একটা পুরানো ঘটনা ইন্টারনেটে ভাইরাল করা হচ্ছে। এগুলোর সংখ্যা খুব কম।

কওমি মাদ্রাসাগুলোর কারিকুলাম ও পাঠদান প্রক্রিয়া নিয়ে খুব শিগগিরই শিক্ষা উপমন্ত্রীর একটি আলোচনায় বসার কথা রয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের সাথে আচরণের বিষয়ে মাদ্রাসাগুলোকে সতর্ক করা হবে বলে জানান কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের এক কর্মকর্তা।  [সূত্র: বিবিসি বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ