দাখিলের পর আলিমে আগ্রহ নেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের

লোগো
লোগো  © সংগৃহীত

দেশে ইনডেস্কধারী দাখিল (এসএসসি) ও আলিম (এইচএসসি) মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। প্রতিবছরেই কমছে এসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বিগত ১০ বছরে (২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত) দাখিলে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হননি। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের এক দশকের তথ্য ঘেঁটে এসব জানা গেছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দাখিল পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন ২ লাখ ১২ হাজার ৯৬৪ জন এবং একই বছরে রেজিস্ট্রেশন করে আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হন প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ২০৯ জন। এভাবে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই যে পরিমাণ শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন, তার অর্ধেকেরও কম সংখ্যক শিক্ষার্থী আলিম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন করেন।

বোর্ডের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০২০ সালে দাখিল পরীক্ষায় পাস করেন ২ লাখ ২৮ হাজার ৪১০ জন এবং আলিম রেজিস্ট্রেশন করেন ৮৮ হাজার ৩০২ জন। ২০১৯ সালে দাখিল পরীক্ষায় পাস করেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৭১০ জন এবং আলিমে রেজিস্ট্রেশন করেন ৮৮ হাজার ৩০২ জন। ২০১৮ সালে দাখিল পরীক্ষায় পাস করেন ২ লাখ ৩ হাজার ৩৮২ জন এবং আলিমে রেজিস্ট্রেশন করেন ১ লাখ ১৩৬ জন। 

আরো পড়ুন: বিজ্ঞান শিক্ষায় পিছিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা, জনবল সংকটকে দায়ী বোর্ডের

এ ছাড়াও ২০২৩ সালে দাখিলে (নবম-দশম) রেজিস্ট্রেশন করেন ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২২৪ জন এবং চলতি বছরে দাখিল (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭২৬ জন পরীক্ষার্থী। 

‘দাখিলের পর কলেজে ভর্তি হওয়ার মূল কারণ হলো আমাদের সময়ে একই সাথে আলিমে বিজ্ঞানের ৪টি বিষয় নেওয়ার সুযোগ ছিল না। আলিম পড়তে হলে বিজ্ঞানের পদার্থ ও রসায়নের সাথে গণিত অথবা জীব বিজ্ঞান নেওয়ার সুযোগ ছিল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আমি শুধুমাত্র বায়োলজিক্যাল ফ্যাকাল্টির সাবজেক্টে অথবা গণিত রিলেটেড সাবজেক্ট নিতে পারতাম অর্থাৎ মেডিকেল অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং -এর দিকে ঝুঁকতে হতো। আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে বাংলা ও ইংরেজিতে ২০০ নম্বরের আবশ্যকতা ছিল। ফলে আমাকে শুধুমাত্র মেডিকেল অথবা ‘ডি’ ইউনিটে আবেদনের সুযোগ ছিল। সুতরাং মাদ্রাসায় আলিম পড়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে কোন সুযোগ ছিল না। এ কারণে দাখিল থেকে আলিম না পড়ে কলেজে ভর্তি হই।’- মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষার্থী 

জানা যায়, দেশে দাখিল মাদ্রাসার সংখ্যা ৬ হাজার ৪৭৪টি, এর মধ্যে ২ হাজার ৭৩১টি মাদ্রাসায় বিজ্ঞান শাখা চালু রয়েছে। আর আলিম মাদ্রাসার সংখ্যা ১ হাজার ৫২৫টি, এর মধ্যে ৫৩৮টিতে বিজ্ঞান শাখা চালু রয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের  সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট মাহফুজ মুর্শেদ। 

২০১১ সালে নীলফামারির ডিমলা কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন আবুল কালাম (ছদ্ম নাম)। পরে তিনি দিনাজপুরের একটি সরকারি কলেজে ভর্তি হন। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার মূল কারণ হলো আমাদের সময়ে একই সাথে আলিমে বিজ্ঞানের ৪টি বিষয় নেওয়ার সুযোগ ছিল না। সে সময় আলিম পড়তে হলে, বিজ্ঞানের পদার্থ ও রসায়নের সাথে গণিত অথবা জীব বিজ্ঞান নেওয়ার সুযোগ ছিল।’

তিনি বলেন, ‘ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আমি শুধুমাত্র বায়োলজিক্যাল ফ্যাকাল্টির সাবজেক্টে অথবা গণিত রিলেটেড সাবজেক্ট নিতে পারতাম অর্থাৎ মেডিকেল অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং -এর দিকে ঝুঁকতে হতো। আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে বাংলা ও ইংরেজিতে ২০০ নম্বরের আবশ্যকতা ছিল। ফলে আমাকে শুধুমাত্র মেডিকেল অথবা ‘ডি’ ইউনিটে আবেদনের সুযোগ ছিল। সুতরাং মাদ্রাসায় আলিম পড়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে কোন সুযোগ ছিল না। এ কারণে দাখিল থেকে আলিম না পড়ে কলেজে ভর্তি হই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি কলেজগুলোতে অথবা মফস্বলের ডিগ্রি কলেজগুলোতে বিজ্ঞান বিভাগের যে পরিমাণ যোগ্য শিক্ষক ছিলেন, তা অনেক ভালো মাদ্রাসাতেও নেই। বর্তমানে বাংলা ও ইংরেজিতে ২০০ নম্বরের বিষয় যোগ হলেও বিজ্ঞানের ৪টি বিষয় নেওয়ার সুযোগ সীমিত। মানবিকের মূল কারণ ছিল, সে সময়ে মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই আইন, বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও লোকপ্রশাসন প্রভৃতি বিষয় নেওয়ার সুযোগ ছিল না। এর মূল কারণ হলো মাদ্রাসা বোর্ডে বাংলা ও ইংরেজিতে ২০০ নম্বরের পরিবর্তে ১০০ নম্বরে পরীক্ষা হতো। এ কারণেই শিক্ষার্থীরা দাখিলের পর আলিমে ভর্তি হতে চান বা মাদ্রাসায় পড়তে চান না।’

আরো পড়ুন: মাদ্রাসায় ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালুর উদ্যোগ

নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ কারামতিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৫ সালে দাখিল পাশ করেন কাউসার উদ্দিন। পরে নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে ২০১৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এ ছাড়াও তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) সমাজ বিজ্ঞান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন। 

তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করা। ছোটবেলা থেকেই আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়তে আগ্রহী ছিলাম, তবে মাদ্রাসায় থাকায় আমাকে মূলত আরবি বিষয়গুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হতো। সাধারণ বিষয়গুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না, যার কারণে আমার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়া কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাকে এক নতুন পথ বেছে নিতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই চিন্তা থেকেই আমি দাখিল শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর আমি জেনারেল লাইনে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি হই। কারণ আমি চেয়েছিলাম, উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো একটি প্রস্তুতি নিতে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। আমার বিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা থাকলে যে কোনো লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। এখন আমি সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছি।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মিঞা মো. নূরুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিগত ১৫ বছরে নানা ইস্যুতে মাদ্রাসায় পড়তে আগ্রহ হারাতেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কমেছে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদ্রাসায় পড়তে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন বিগত সময়গুলোতে মাদ্রাসায় পড়ে শিক্ষার্থীরা পরিচয় দিতে সংকীর্ণতায় পড়তেন। কারণ পলিটিক্যাল বিষয়সহ নানা ইস্যু ছিল। তবে মাদ্রাসা শিক্ষার মান যুগোপযোগী করতে কাজ চলমান রয়েছে।’ 


সর্বশেষ সংবাদ