বেলালের আলাপন: ৪
উৎখাতের ইতিহাস এখন ‘ধুলিধূসর’ অতীত
বিশ্বে ৪০টির দেশে ৫ হাজার আদিবাসী রয়েছে। জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। বিভিন্ন দেশে প্রথম জাতি, উপজাতি, আদিবাসী, ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠি, ক্ষুদ্র-জাতিসত্ত্বা হিসেবে ডাকা হয় এদের। বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরণের জনগোষ্ঠী নানা নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
তাদের অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছরের ৯ আগস্ট পালন করা হয় বিশ্ব আদিবাসী দিবস। বাংলাদেশে ২০০৪ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এর আগে ১৯৫৭ সালে ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠির অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা একটি কনভেশন করে। এছাড়া ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ।
মহামারিতে আদিবাসীদের অধিকার ও তাদের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরীর সাথে আলাপন করেছে— বেলাল হোসেন
বেলাল হোসেন: আদিবাসী, উপজাতি না ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী এ বিতর্কের ইন্ধন কোথায়? বাংলাদেশের জন্য এই আলোচনা কিভাবে সংগতিপূর্ণ
মানস চৌধুরী: কোনো শব্দের অর্থ কিয়ামত পর্যন্ত এক থাকার কথা নয়। তবে যেসব শব্দ সরাসরি অনুদিত এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যকার সেগুলোর জটিলতা ভিন্ন হয়। ‘উপজাতি’ শব্দটি ঔপনিবেশিক সরকার ও প্রগতিবাদী রাজনীতিকর্মীরা ‘ট্রাইব’-এর বাংলা হিসেবে নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে শব্দচয়নে আপত্তি করা ত্রুটিপূর্ণ।
অন্যদিকে ‘আদিবাসী’ জাতিসংঘের ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের প্রতিরুপ। বর্তমানের সরকারি মানুষজন বিরোধীদলে থাকতে এটার মুখ্য অনুগ্রাহী ছিলেন, এখন তীব্র বিরোধী। কারণ, খুবই স্পষ্ট। ‘ইন্ডিজেনাস’-এর অন্তর্গত অর্থ ও তার রাজনৈতিকতা। তখন যা বাতাস দিয়েছেন, এখন জাতীয়তাবাদী অহংকারে তা থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। আমি শব্দ নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম চিন্তিত, যতটা চিন্তা ও স্বার্থের পাটাতন নিয়ে।
বেলাল হোসেন: আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত দিবসটি উদযাপনে দেশে এক ধরনের উদাসীনতা দেখা যায়। এর ব্যাখ্যা কী?
মানস চৌধুরী: এখন তো করোনাকাল। তাছাড়া এবছর সরকারের আগ্রহের বিষয়ে এসব দিবস নেই। তবে সারাংশে, আমার মনে হয় এ দিবসটি আবারও ওই পদবাচ্যের পেছনকার রাজনীতিটা সামনে নিয়ে আসে। সরকার জাতীয়তাবাদীদের গরিমা বা ক্রোধের বাইরে থাকতে চান না।
বেলাল হোসেন: করোনায় আদিবাসীদের প্রতি দেশের নাগরিকদের সচেতনতা কেমন?
মানস চৌধুরী: অন্যান্য জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ আমি আন্দাজ করতে পারি। বাঙালি শ্রমিক-চাষি ও সাধারণভাবে কর্মহীন গরীবদের প্রতি কর্তব্য তো দেখতেই পাচ্ছি।
বেলাল হোসেন: মহামারিতে এবছর বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদযাপনের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে কিভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন
মানস চৌধুরী: এটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ আলাপ, তবে সরাসরি বলা ভাল। আমি খুব একটা ‘দিবস’ প্রেমিক নই। প্রান্তিক মানুষজনের স্মারক দিবসগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে মর্যাদা দেয়া যায়। এতে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অর্থ তৈরি হয়। কিন্তু নানাদিবস, বন্ধুদিবস, বেলুন দিবসের ভিড়ে যেগুলোর অন্তত ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব হতে পারত সেগুলো লঘু হয়েছে বলে আমার মনে হয়। অন্যদিকে জাতিসংঘ ও তার বন্ধুপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এসব অবশ্যপালনীয় ধরনের ‘অনুষ্ঠান’।
বেলাল হোসেন: আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ‘স্বতন্ত্র আদিবাসী ভূমি কমিশন’ এখনো বাস্তবিক রুপ পায়নি। আপনি কি মনে করেন এ ধরনের একটি কমিশন দখল ও উচ্ছেদের ঘটনা প্রতিহত করতে সক্ষম।
মানস চৌধুরী: তাঁদের দাবির কারণ তো আমরা সকলে বুঝি। আপনার কথায় পরিষ্কার যে প্রশাসনের নিয়ত বা সদিচ্ছার কোনো বস্তুনিরপেক্ষ দশা নেই। এখানে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সামষ্টিক মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটবে, এমনকি কমিশন একটা হলেও। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের উদাহরণেও দেখা যায় ব্যক্তিবিশেষে গুরুতর ভূমিকা বদল ঘটেছে। মনে করার কারণ আছে যে, প্রবল জাতীয়তাবাদী সরকারের কিছু ভক্তই সেটা পরিচালন করেন।
বেলাল হোসেন: ভূমিহীনতা ও পেশাহীনতার সংকট পুঁজি করে ব্যাপক হারে ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া চলছে। এতে স্বকীয়তা হারাচ্ছে নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতি। এ ধরনের উত্তরাধিকার সংকট মোকাবিলায় জাতি গোষ্ঠীগুলোর ভবিষ্যত কি হতে পারে?
মানস চৌধুরী: খুব নৈরাশ্যবাদী শোনাতে পারে, কোনো আশাব্যঞ্জক গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাই না। আমরা যে এলাকাটাতে বসবাস করি এর সমতলে মুণ্ডা, সাঁওতাল, কোচ, ওঁরাও, খাসি, মান্দিসমেত বহুজাতির বিচরণ ছিল। আরো সহজে বলি, জাতি বা জনজাতি প্রসঙ্গ বাদ দিলেও। মুঘল আর ব্রিটিশ আমলের ঢাকা মহানগরী যেরকম বহুজাতিক ছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী ঢাকা তো একদমই তা নয়। এখানে তো উর্দুভাষী এবং শিয়া মুসলমানই কোণঠাসা!
বেলাল হোসেন: ১৯৪৭ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের আদিবাসীরা আন্তঃদেশীয় চলাচলে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এ অঞ্চলের আদিবাসীদের দাবি একটি আন্তঃসীমান্ত চুক্তি। সমস্যা নিরসনে জাতিরাষ্ট্রগুলো কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে?
মানস চৌধুরী: এখানকার রাষ্ট্রশাসকেরা সাধারণ গ্রহণযোগ্য মধ্যবিত্তদের পরিবারগুলো যে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে সেটাকে উপলব্ধি করেই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এটা অত্যুক্তি হবে না যে এই অঞ্চলের শাসকদের প্রধান চালিকাশক্তি ‘অন্যরাষ্ট্রে’র জুজুবুড়ি দেখিয়ে চালানো। এখানে আদিবাসীদের কথা কানে তোলার নিকট ভবিষ্যতে আমি কোনো সম্ভাবনা দেখি না।
বেলাল হোসেন: এ অঞ্চলের আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদার তুলনায় ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার আদিবাসীদের অবস্থান নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
মানস চৌধুরী: এই তুলনার জন্য যেসব উপাত্ত তা নিদিষ্ট কিছু সংস্থা থেকেই আসে। ফলে তুলনা করা কঠিন। তবে সাধারণভাবে ওইসব রাষ্ট্রের দীর্ঘ আদিবাসী নিধনের ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে কিছু ‘সংরক্ষণমূলক’ পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। ওটা ওদের রাষ্ট্রীয় মডেলেরই আবশ্যিক একটা দায় ছিল। ফলে যাঁরা পুরাপুরি নির্ব্বংশ হননি কয়েক শত বছরে তাঁদের ‘আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি’ আমাদের মত দেশগুলোর তুলনায় আরামদায়ক দেখতে।
বেলাল হোসেন: আদিবাসীদের ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে বাংলাদেশের উদ্যোগ কতটুকু সফল?
মানস চৌধুরী: ‘সংরক্ষণ’ এমনিতেও পুরাপুরি মৃত মানুষ ও প্রচলনের জন্যই বেশি কার্যকরী। কিছু উদ্যোগ কাগজে-কলমে হয়েছে।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন রাজনীতি ও আদিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থানের সম্পর্ককে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মানস চৌধুরী: বাংলাদেশের উন্নয়ন মেশিনে একদম সম্মুখসারির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অবাঙালি জাতিসমূহ। কখনো নিরাপত্তার নামে কখনো বনায়নের নামে পার্বত্য এলাকা ও গড় এলাকার প্রকৃতি ধ্বংস করা হয়েছে। উভয়ক্ষেত্রে হয়েছে আসলে লুটপাট। উন্নয়ন রাজনৈতিক মিশনের প্রতিপক্ষ যদি বাঙালি কেউ হন, তাঁরও বেঁচেবর্তে থাকা খুব কঠিন।
ফলে চলেস রিসিল বা মাইকেল চাকমার মতো মানুষজনের মৃত্যু বা অন্তর্ধান নিয়ে মনোযোগ দিয়ে ভাবা দরকার। আমি বলব, উন্নয়ন মিশনকে যাঁরা নিছক এনজিও তৎপরতা কিংবা বাণিজ্য তৎপরতা হিসাবেও দেখেন, তাঁরা নেক্সাসটা মিস করে যান। সামরিকতন্ত্র, ঠিকাদারতন্ত্র, বাণিজ্যতন্ত্র, বৃহৎ এনজিও, আমলাতন্ত্র সকলের একটা নেক্সাস এটা।
বেলাল হোসেন: উচ্চশিক্ষায় আদিবাসী তরুণদের অংশগ্রহণ, জাতি গোষ্ঠীগুলোকে কিভাবে দেশের মূল স্রোতধারায় আসতে প্রভাবিত এবং পরিবর্তনে সহায়তা করছে?
মানস চৌধুরী: মূল স্রোতধারা একটা অতিকথন। এটা দীর্ঘ আলাপ-বিতর্কের দাবিদার। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের ২০টা আসন কিছু বদলে সহায়তা করে না। এগুলো তাঁদের অস্তিত্বকে স্বীকারের সর্বোৎকৃষ্ট বা একমাত্র উপায় নয়। অন্যান্য অনেক প্রসঙ্গের পরিপূরক হতে পারত মাত্র।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশে পাহাড়ি উপজাতিরা যেভাবে আলোচনায় আসতে পেরেছে, সে তুলনায় সমতলের আদিবাসীরা আর্থ সামাজিক বিবেচনায় বঞ্চিত হয়েছে। ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখছেন?
মানস চৌধুরী: পার্বত্যবাসীদের একাংশ একটা সময়ে গেরিলাযুদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম তাঁদেরকে দীর্ঘকাল দৈত্যাকারে হাজির করার কারণ খুঁজে পেয়েছেন, ইত্যাদি! কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়। ‘আলোচনায় আসা’কে অপেক্ষাকৃত সহজে বোঝা যায়। কিন্তু সাঁওতাল বা মান্দি বা ওঁরাও বা মুণ্ডাদের উৎখাতের ইতিহাস এখন ‘ধুলিধূসর’ অতীত। সতর্ক থাকতে চাইব আমি। পার্বত্য এলাকায় বাঙালির নিরঙ্কুশ দখল প্রবণতার কালটা আপনার আমার জৈবকালে ঘটছে বলে হয়তো ‘লক্ষ্য’ করছি বেশি।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশে আদিবাসীদের প্রতি জাতিগোষ্ঠী বিদ্বেষ নিয়ে কি বলবেন?
মানস চৌধুরী: বাংলাদেশে বিদ্বেষ এমনিতেও প্রায় এই অঞ্চলের মেঠাইয়ের মতোই বহুবিধ বিচিত্র। এখানে জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় বিদ্বেষের চর্চার সুনিপুণ ইতিহাস। আর অন্যজাতির প্রতি তো বলাই বাহুল্য।
যে পশ্চিম ইউরোপের প্রতি শ্রদ্ধায় শরমে অবনত থাকা আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর আমৃত্যু ব্রত, তাঁদের অনেকেই একান্তে পাওয়া বিলাতীকে, বিশেষত নারীকে, আক্রমণ করতে অভ্যস্ত। এ ধরনেরর পরিবেশ অন্য জাতির জন্য খুব অনিরাপদ বলে আমি মনে করি। বিশেষত এই অঞ্চলের নিজস্ব জাতিসমূহের প্রতি শ্রেণীবিশেষের কাঠামোগত বিদ্বেষ ভয়ানক। এর কারণ নিয়ে নানাবিধ আলাপ প্রয়োজন। কিন্তু এটা যে সারানো যাচ্ছে না তার সিংহভাগ দায় আমি রাষ্ট্রীয় শিক্ষাদান কাঠামো বা লেখাপড়ার ব্যবস্থাকে দেব।
বেলাল হোসেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ একটি সুন্দর ও প্রাঞ্জল আলাপনের জন্য।
মানস চৌধুরী: আপনাকেও পাঠকদের অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।