শিক্ষকরা জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ
- মোঃ রাকিবুল হাসান তামিম
- প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২০, ০২:৫২ PM , আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২০, ০৩:০৬ PM
আজ ’বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি উদযাপিত হয়। বিশ্বের অন্তত ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মূলত দিবসটি শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি এবং মানুষ গড়ে তুলতে তাঁদের অবদানকে স্মরণ করার জন্যই পালন করা হয়।
আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’ (Education International - EI) এবং এর সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন দিবসটি পালনে মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
শিক্ষক দিবসের এবছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো — ‘ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় শিক্ষকসমাজ’।
“যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত”। যুগের পর যুগ জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের ধারকগণের মন, মগজ, মস্তিষ্কের পরিস্ফুটন ঘটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষকরাই হলেন জাতির প্রধান চালিকা শক্তি। ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ শিক্ষকদের হাত ধরেই উদিত হয় জাতির সেবকদের।
বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষক দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হলেও বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত হয় না।
আজকের এই আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস উপলক্ষে জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা, শিক্ষক সমাজের বর্তমান অবস্থা, আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য সহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় মতামত ব্যাক্ত করেছেন— মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা এর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং স্বাধীনতা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সংসদ’র যুগ্ম আহবায়ক অধ্যাপক এস এম আমিরুল ইসলাম (পলাশ)। সেই আলাপচারিতার চম্বুক অংশ তুলে ধরেছেন — মোঃ রাকিবুল হাসান তামিম
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শুরুতেই আপনাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা স্যার। প্রথমেই জানতে চাইবো বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেমন আছে শিক্ষক সমাজ?
অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম (পলাশ): ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। আমরা সবাই একটি সংকটকালীন সময় পার করছি। করোনার ভয়াল থাবায় আমাদের দেশেই পাঁচ হাজারের উপর মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। এই মৃত্যুর ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। আমাদের অনেক শিক্ষকরাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই আবার পুরো পরিবারসহ আক্রান্ত হয়েছে। আবার দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেসরকারি অনেক শিক্ষকরাই বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অনেক সংবাদেই এসব শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়গুলো দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরাও আমাদের সাধ্যমত তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি এবং এখনো করছি। তবে আমার প্রত্যাশা হচ্ছে শিগগিরই এমন অবস্থার অবসান ঘটুক। সুন্দর পৃথিবীতে সবাই একসাথে বেঁচে থাকি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আদর্শ জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা সম্বন্ধে আপনি কি বলবেন?
অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম (পলাশ): শিক্ষকরা হলো জাতি গঠনের নিপুণ কারিগর। কেননা একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই একটি দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির গতিপথ বেগবান হয়। একটি জাতির শিক্ষা বিভাগ যখন সাফল্যের মুখ দেখে তখন অন্যান্য বিভাগ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সফলতার মুখ দেখে। জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দানের মাধ্যমে জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখে। শুধু শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে গড়ে তোলারই প্রচেষ্টাই শিক্ষকরা করেন না বরং একইসাথে নৈতিকতা, মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেও কাজ করেন তাঁরা। মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার রয়েছে তারমধ্যে শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার কিন্তু এটি বাকি চারটি মৌলিক অধিকারকে প্রভাবিত করে। এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখেই শিক্ষকরা আলোকিত মানুষ তৈরীর প্রচেষ্টা চালান। জাতি গঠনের নিরলস প্রচেষ্টার উপরই একটি সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র বা সভ্যতার ক্রমবিকাশ নির্ভর করে। আমেরিকার ইতিহাসবিদ হেনরি এডামস শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, “একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেন, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়।”
দার্শনিক বাট্রার্ন্ড রাসেল বলেছিলেন, “শিক্ষক সমাজ হচ্ছেন প্রকৃত সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। এ কারণেই শিক্ষকদের বলা হয় সমাজ নির্মাণের স্থপতি।” সুতরাং একথা সহজেই অনুমেয় যে একটি আদর্শ জাতি গঠনে সুনাগরিক তৈরীতে শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: স্যার অনেকেই বলে, এক দশক আগেও ছাত্র–শিক্ষকের মাঝে যে বন্ধন ছিলো বর্তমানে সেটি বিলুপ্তপ্রায়। আপনি ও কি তাই মনে করছেন?
অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম (পলাশ): দেখুন একজন আদর্শ শিক্ষক হলেন সমাজ তথা সভ্যতার বাতিঘর। বাবা মা যেমন অপত্য স্নেহ দিয়ে সন্তানদের বড় করে তুলেন তেমনি একজন শিক্ষকও পরম স্নেহে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের আলো বিতরণ করেন। শিক্ষকরা তাঁদের শিক্ষার আলো দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। এক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষক–শিক্ষার্থীর বন্ধন একেবারেই নেই তা বলবো না, হয়তো আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে। আর বর্তমান সময়ে আমরা মানুষের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। হয়তো এই অবক্ষয়ের দরুন কিছুটা ঘাটতি হয়েছে। তবে আমি মনে করি একজন শিক্ষকের শিক্ষার আলো যেমন শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাঁদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করবে এবং বন্ধন সুদৃঢ় করবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি কেন শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হলেন?
অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম (পলাশ): দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘যাঁরা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তাঁরা অবিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মাননীয়।’ আমি আমার সেই ছোট্ট সময় থেকেই একটি কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীতে যতরকম পেশা রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষকতা হলো সর্বাগ্রে। কারন হচ্ছে বাবা-মা আমাদের লালনপালনের মাধ্যমে সুন্দর একটা জীবনদান করেন ঠিকই কিন্তু একজন শিক্ষক সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। তারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে একজন আদর্শ শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের অন্তরের অন্তস্তলে বেঁচে থাকেন হাজার বছর। এসব চিন্তা ভাবনা থেকেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছি। সবসময়ই চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের খুব কাছাকাছি থেকে তাদের সুপথে পরিচালনার দিকনির্দেশনা দেওয়ার।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: স্যার আমাদের দেশের শিক্ষকদের দুর্দশার শেষ নেই। অর্থনৈতিক দৈন্যদশার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অনেক শিক্ষকেই খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
একজন শিক্ষক নেতা হিসেবে আপনি কি বলবেন?
অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম (পলাশ): হ্যাঁ একথা সঠিক। অনেকক্ষেত্রেই শিক্ষকরা অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এরপর আবার প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় একজন শিক্ষিত মানুষকে অনেকক্ষেত্রেই কমশিক্ষিত কোন ব্যক্তি বা পরিচালনা কমিটি কাছে নতজানু থাকতে হচ্ছে। আমরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। তারপরও সারাদেশেই সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: স্যার সর্বশেষ জানতে চাই, আজকের এই আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসে আপনার অনুভূতি কি?
অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম (পলাশ): শিক্ষকতা মহান পেশা। শিক্ষকরা হলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সস্পদ। জাতিকে সুপথে পরিচালনা করার জন্য সুনাগরিক তৈরীতে শিক্ষকদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তবে একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই জাতির কান্ডারী এসব মানুষকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্মান এবং সুযোগ সুবিধা প্রদান করাও অপরিহার্য। তাঁদের যথাযথ সম্মান প্রদান করলে জাতির উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি আরো ত্বরান্বিত হবে বলে আমি মনে করছি। একই সাথে আমরা সব শিক্ষরা এক মনপ্রাণ হয়ে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য যোগ্য সুনাগরিক তৈরীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করবো এই প্রত্যাশাও ব্যাক্ত করছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।
অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম (পলাশ): আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস পরিবারের জন্য শুভকামনা জ্ঞাপন করছি।