জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা সব বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেছিল : ফাইয়াজ

কিশোর হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে হাতকড়া অবস্থায় আদালতে তোলা হয়েছিল
কিশোর হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে হাতকড়া অবস্থায় আদালতে তোলা হয়েছিল  © সংগৃহীত

হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজ কারাবরণ করা একজন কিশোর জুলাই যোদ্ধা। ২৪ জুলাই রাতে পুলিশ তাকে মাতুয়াইল থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং তিন দিন পর ডিবি অফিসে পাঠানো হয়। সেখানে মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ায় তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সী সাহসী এই কিশোরকে আদালতে তোলা হয় হাতে দড়ি বাঁধা অবস্থায়। আদালত তার রিমান্ড মঞ্জুর করলে ফুঁসে ওঠে দেশবাসী। প্রতিবাদে তার রিমান্ড বাতিল করে গাজীপুর কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।

রাজনীতি সচেতন ফাইয়াজ ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তিনি সত্য ও ন্যায়ের জন্য যে কোনো সংগ্রামে রাজপথে নামতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, রাজপথে দাঁড়িয়ে বুঝেছিলাম, এই আন্দোলনে যারা ছিলেন, তারা ক্লান্তিহীন। তারা সব বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেছিল।

হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজের জন্ম ১৯ এপ্রিল ২০০৭ সালে নোয়াখালীতে। পিতা আমিরুল ইসলাম ও মা কামরুন নাহারের সাহসী সন্তান তিনি। ফাইয়াজ ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে বাসসকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজ। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হয়।

আপনি দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রথমে শুনতে চাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনি কেন অংশগ্রহণ করলেন?
আমাদের তখন এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছিল এবং সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ১৬ জুলাই রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছয় শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন। অবিশ্বাস্য লাগছিল। কিন্তু নিউজফিডে শহীদ আবু সাঈদ ভাইয়ের অন স্পট শাহাদাতের ভিডিওটি দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এর পর অনেকক্ষণ ধরে কান্না করেছিলাম। স্বাভাবিক কোনো মানুষের পক্ষে সে দৃশ্য সহ্য করা কঠিন ছিল। এরপর আমরা বন্ধুরাসহ সবাই মিলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ১ বছর পূর্ণ হলো। জুলাইয়ের সেই স্মৃতি কতটা অনুভব করেন?
আন্দোলনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গেলে ওই সময়ের কিছু উপলব্ধি বেশ নাড়া দেয় মনে। রাজপথে দাঁড়িয়ে বুঝেছিলাম, এই আন্দোলনে যারা ছিলেন, তারা ক্লান্তিহীন। তারা সব বাধাকে তুচ্ছ হিসেবে গ্রহণ করেন।  এক্ষেত্রে সকলের শক্ত মানসিকতা ছিল। দুপুরের প্রচণ্ড রোদের মধ্যেও তাদের স্লোগান বন্ধ হতো না, ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েও ক্লান্ত হতো না, টিয়ারশেলেও পিছপা হতো না তারা।

এই আন্দোলনে যখন যাত্রাবাড়ী থানার মাতুয়াইল অঞ্চলের রাজপথে অবস্থান করতাম, তখন দিন যেতো ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিছুক্ষণ পরপরই রাজপথ থেকে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হতো। কারো অবস্থা অনেক খারাপ থাকতো। এর আগে কখনো এমন রক্তাক্ত অবস্থায় আমি কাউকে দেখিনি। হঠাৎ করে আমার সামনেই একজনকে মারা যেতে দেখলাম। নিথর শরীর রাস্তায় পড়ে আছে। একজন তার শার্ট নিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছিল। শার্টের মাঝখানে বুলেটের আঘাতে ছিদ্র হয়ে আছে এবং রক্তের দাগ। আমার কাছে অবাস্তব লাগছিল বিষয়গুলো। কিন্তু রাস্তা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারতাম না। ভাইদের ফেলে আসার কথা চিন্তা করতে পারতাম না। এখন এগুলোই বারবার আমার স্মৃতিতে ভেসে আসছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৭ বছর বয়সে আপনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তার মানে আপনি শিশু বা কিশোর। কিন্তু পুলিশ আপনাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আদালতে তোলে। সেই ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই।
প্রতিদিন সাইকেল নিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার সময় স্থানীয় দোসরদের চোখে পড়ে যাই। তারা বুঝে যায় যে আমি আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। ফলে তারা স্থানীয়ভাবে যে তালিকা তৈরি করে সেখানে আমার নামও ছিল বলে জানতে পেরেছিলাম। আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলসহ ওই স্পটের বড় ভাইদেরকে পানি ও খাবার বিতরণ করতাম বলে তারা সহযোগিতাকারী হিসেবে আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করে। এর পাশাপাশি আন্দোলন চলাকালীন আমি প্রায়শই স্লোগান দিয়ে সবাইকে উজ্জীবিত করতাম। এসব কারণে আমি তাদের টার্গেট হই।

স্থানীয় আওয়ামী দোসরদের করা তালিকায় আমার নাম থাকায় ২৪ তারিখ রাতে পুলিশ বাসায় এসে আমাকে গ্রেফতার করে। এর আগে আমাকে খোঁজার জন্য একটি বিল্ডিংয়ের প্রতিটি ফ্ল্যাটে তারা তল্লাশি চালায়।

গ্রেফতার করেই গাড়িতে করে রায়েরবাগের এক জায়গায় নিয়ে তারা আমার ফোন দিয়ে আমার বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক এবং আন্দোলনের সময় ওই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা রাশেদ ভাই, মাসরুর ভাই এবং আসিফ ভাইকে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু আমি তাতে সাড়া দেইনি। এতে তারা চরম ক্ষিপ্ত হয়।

আমাকে থানায় নিয়ে টর্চার শুরু করে। রাত তখন ১২টা, আমাকে একটা মামলার মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তারা জোর করে। যেখানে তারা কয়েকজনকে দেখাবে আর আমাকে বলতে হবে যে ‘হ্যাঁ, এরা এ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। আমি তখন বলি যে ‘আমি যা করিনি, যা দেখিনি, সেই সাক্ষ্য কেন দেব।’ তখনই আমার ওপর অনেক নির্যাতন করা হয়। আমাকে ফ্লোরে শরীর চেপে ধরে পায়ের তালুতে ক্রমাগত লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। ধীরে ধীরে আমার কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত প্রত্যেকটা জায়গায় সজোরে আঘাত করতে থাকে। আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম তাদের নির্যাতনে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল তবু আমি একটি বারও তাদের মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তাবে রাজি হইনি। ব্যথা সহ্য করে গিয়েছি।

আপনি কত দিন কারাগারে ছিলেন?
আমাকে গ্রেফতার পরবর্তী ৩ দিন গুম করে রাখা হয়। পরে থানা থেকে ডিবিতে প্রেরণ করা হয়। সেখানে আমাকে একটি রুমে রাখা হয়। এ রকম ৩টি রুমে প্রায় ১২৭ জন ছিল। যাদের বেশিরভাগই ছিল আন্দোলনকারী। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরাও সেখানে ছিলেন।

ডিবিতে এসে দেখলাম সবাই দোয়া করছে যেন জেলহাজতে যেতে পারে। পরে বুঝলাম এখানে এনে বেশিরভাগ মানুষকেই গুম করে ফেলা হয়। এ জন্যই সবাই এই রকম দোয়া করছিল।

ডিবিতে আমাকে দেখে আমার কলেজের এক ভাই এগিয়ে আসে। আমার বিস্তারিত সব জেনে নেয়। যার সাথে আমার আগে কোনোদিন পরিচয়ও ছিল না। আমার অবস্থা দেখে সেই ভাইয়ের খারাপ লাগে এবং আমার যত্ন করে। কিন্তু ওই ভাইয়ের পায়ের আঙুল সব ভেঙে দিয়েছিল নির্যাতন করে।

ডিবিতে দুই দিন রেখে আমাকে কোর্টে উপস্থিত করলে সাত দিনের রিমান্ড দেওয়া হয়। তবে আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা রেখে সাহস রাখার চেষ্টা করছিলাম।

পরদিন শুনি মানুষের প্রতিবাদের মুখে আমার রিমান্ড বাতিল করেছে এবং গাজীপুরে কিশোর সংশোধনাগারে প্রেরণ করার আদেশ এসেছে। কিশোর সংশোধনাগারের পরের সময়টা পুরোটা ছিল ভিন্ন রকম। প্রতিটা মুহূর্ত আমি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম। দোয়া করতাম। এভাবে হঠাৎ একদিন এলো ভিন্ন সূর্যোদয়। যে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় ছিল সারা দেশ।

আমাকে প্রথমদিকে জেলের সেলে প্রবেশ করানোর সময় এক আনসার সদস্য বলছিল, ‘কি দরকার ছিল এই আন্দোলন করার? শুধু শুধু তোমার জীবনটা শেষ করে দিলে।

এখন তো তোমার জীবন পুরাটাই শেষ।’ আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম সেদিন। আমি কারাগারে সেইদিন রাতে আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম। আমার মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি যেন বয়ে যায় সেদিন। আমার জন্য অনন্য সাধারণ ছিল সে বিষয়টা।

আন্দোলনে আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কেমন ছিল?
সহযোগিতাপূর্ণ ছিল। আমাদের শিক্ষকবৃন্দ আমাদের সাহায্য করতো। তারা আন্দোলনকারীদের পানি, বিস্কুট কিনে দিতেন। আমি গ্রেফতার হওয়ার পর আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজের প্রত্যেক শিক্ষার্থী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে বাঁধা আসা সত্ত্বেও তারা যাত্রাবাড়ী অঞ্চলে আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলে। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনো কাউকে বলেননি এমন কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি জানতে চাই।
এ ক্ষেত্রে আমার একটা ঘটনা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। আমাকে যখন টর্চার করা হয় সেখানে এমন একজনকে আমি দেখতে পাই যাকে আমি আন্দোলন চলার সময় আন্দোলনকারী ভেবে পানি দিয়েছিলাম। বুঝতে পারি তিনি ছিলেন মূলত তথ্যদাতা।

সরাসরি জুলাইয়ের কত তারিখে কোথায় আন্দোলনে যুক্ত হন?
১৭ জুলাই মাতুয়াইল আমার বাসার পাশে। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পরের দিন রাজপথে নেমেছিলাম।

৫ আগস্ট তথা ৩৬ জুলাই হাসিনা পালানোর খবর প্রথম কখন কীভাবে পান? সেই অনুভূতি কেমন ছিল?
আমি কারাগারেই ছিলাম। সেখানে শিশু-কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রে থাকা টিভিতে হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে পাই। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। দেখছিলাম সেনাবাহিনী প্রধান ভাষণ দেবেন। কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি খুনি পালিয়ে যাবে। তবে তার বিচার হতে হবে। যেন আর কখনো কেউ এভাবে একজন মানুষও হত্যা করতে না পারে।

আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ বা ছাত্রলীগের হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
বিরূপ প্রভাব ফেলে ছিল। এর কারণেই আমাদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং স্বৈরাচারের পতন হয়। আর যেসব পুলিশ সরাসরি গুলি করেছে, মানুষ হত্যা করেছে, তাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। 

জুলাই আন্দোলনের নারী শিক্ষার্থীরা ভিন্ন মাত্রা দেয়। তাদের নিয়ে কিছু বলুন?
আমার সহপাঠী নারী শিক্ষার্থীদেরকেও দেখেছি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। তাদের ভূমিকা অবর্ণনীয়। তারা রাজপথে আমাদের ঢাল হয়েছিল।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কোন দিনটি আপনাকে এখনো বিশেষভাবে আলোড়িত করে?
আন্দোলনের প্রতিটি দিনই বিশেষভাবে আলোড়িত করে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কতটা হলো? নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কী?
কিছু অংশ হয়েছে। কিছু অংশ হয়নি। আমরা প্রত্যাশা রাখি আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হবে। এই দেশের মানুষ সৎ, দক্ষ ও আদর্শ দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে উঠবে এবং বাংলাদেশে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
সূত্র: বাসস


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence