বাংলাদেশে আর যেন কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে: আয়মান আহাদ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৬:০১ PM , আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৬:০১ PM
স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও যার সমাপ্তি ঘটে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের একদফার মাধ্যমে। সৃষ্টি হয় নতুন বাংলাদেশের। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে লড়াই করেছিলেন এদেশের আপামর ছাত্র-জনতা। সেই আন্দোলনে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
সেই সময় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনায় যেসব শিক্ষার্থী সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ডিসিপ্লিনের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মো. আহাদ হোসেন (আয়মান আহাদ)।
বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার বালিয়াতলি শফিপুর গ্রামের মৃত আলমগীর মিয়ার সন্তান আয়মান আহাদ। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খানজাহান আলী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা মহানগরের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তিনি বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার নানা স্মৃতি বর্ণনা করেছেন। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে, সেই সংগ্রামী সময়ের স্মৃতি এখনও অনুভব করতে পারেন কি না?
হ্যাঁ, অবশ্যই অনুভব করতে পারি। জুলাইয়ের সেই স্মৃতিগুলো এখনও মনে পড়ে। প্রতিমুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই স্মৃতিগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ৩০ জুলাই আমাদেরকে যখন সার্কিট হাউজে ধরে নিয়ে যায়। সেটা একটা ভয়ংকর রাত ছিল। সেখানে নিয়ে শারীরিক আঘাত ছাড়া যত ধরনের গালিগালাজ হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিতে বাধ্য করে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতারা। সেটা একটা ভয়ংকর রাত ছিল। এ ঘটনা স্মৃতিকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল?
সেদিন জুলাইয়ের ৪ তারিখ ছিল। আমরা তখন ক্লাস থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে প্রতিদিনের মতই বসি। তখন আমি, আজাদ, জহুরুল তানভীর, মুহিবুল্লাহ মুহিবসহ কয়েকজন আদালতের দেওয়া কোটা বহাল রাখার রায় নিয়ে আলোচনা করি। তখন আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলন শুরু হচ্ছে। তখন আমরাও তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরাও এর প্রতিবাদে আন্দোলন করবো। এভাবেই শুরু হয় আন্দোলনের সূত্রপাত।
আপনি কি শুরুতেই জানতেন যে এই আন্দোলন স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে?
না, আমরা কখনও সে রকম ভাবিনি। প্রথম পর্যায়ে আমাদের চাওয়া ছিল শুধু কোটা বাতিল। সরকার পতন বা এ ধরনের কোন চিন্তা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেখলাম যে আবু সাঈদ গুলির সামনে বুক পেতে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেন, পরবর্তীতে ২০ জুলাই মুগ্ধ ভাই মারা যান। মুগ্ধ ভাই মারা যাওয়ার পর তখন ডিটারমাইন্ড হয়ে যাই যে আর ফেরার আসলে কোনো পথ নেই। হয় মরব তা-না হলে দেশ স্বাধীন করব। এ রকম একটা চেতনা আমাদের মধ্যে কাজ করে। বিশেষ করে যখন পুলিশের গুলিতে একের পর এক লাশ পড়ছে তখন আমাদের মধ্যে একটি বিষয় কাজ করে যে ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন ছাড়া ঘরে ফেরার আর কোন সুযোগ নেই।
আন্দোলনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল?
শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ শুরু থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের সাপোর্ট এবং সহযোগিতা করেছে। তারা মিছিলে অংশ নিয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা এবং আশপাশের অন্যান্য স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে অংশ নেয়। এখানে সিনিয়র জুনিয়র সবাই ছিল। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুই থেকে তিন হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।
ক্যাম্পাসে অহিংস কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিল কীভাবে ?
প্রথমেই যদি বলি সহিংস রূপটা খুলনায় প্রথম শুরু হয় ৩০ জুলাই। আমরা ক্যাম্পাস থেকে কয়েকজন শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান করি। তখন ডিবির ডিসি নুরুজ্জামান এসে বলে আমাদের এখানে মিছিল করতে দেবে না। তখন আমি এবং অন্যান্য কলেজের কয়েকজন জুনিয়র শিক্ষার্থী সামনে এগিয়ে গেলে ওদের গায়ে হাত তোলে। আমার পাশে হেলাল ভাই ছিল উনার গায়েও হাত তোলে। পরে শাহরিয়ার ভাইও আসে। তখন আমি এগিয়ে গেলে তিনি কলার ধরে আমাকে ধাক্কা দেন। এছাড়াও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দিয়ে জোর করে আমাদেরকে হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। এছাড়া মুগ্ধ ভাই মারা যাওয়ার পর আমরা সকল বাধা ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করি। এমনকি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা ভেঙে প্রবেশ করি। পরবর্তীতে ৩১ জুলাই যখন আমরা সাতরাস্তা মোড়ে কর্মসূচি দিই, তখন সেখানে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে এবং পরবর্তীতে ২ আগস্টও পুলিশ আমাদের কর্মসূচিতে হামলা চালায়। এভাবে মূলত অহিংস আন্দোলন সহিংসতার রূপ ধারণ করে।
আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং হুমকি- সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
অনেক বেশি প্রভাবিত করে ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ১৬ জুলাই ছিল, ওই রাতেও আমাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের ফোন আসে যে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালাবে। এ জন্য সারারাত ঘুমাইনি। এভাবে ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে অগণিত রাত আমাদের নির্ঘুম কেটেছে, যতদিন না ৫ আগস্ট এসেছে, ততদিন আমরা ভয়ে থাকতাম- কখন না ছাত্রলীগের হামলা হয়। এছাড়া প্রশাসনের থেকেও থ্রেট পেতাম যে তারা বলত, আমরা আপনাদের সাবধান করছি, আপনারা হামলার শিকার হবেন। এভাবে অনেক ধরনের হুমকি ছিল। এসব হুমকির কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রথমে ভয় পেয়ে একটু নিজেদেরকে সংকুচিত করে রাখতো। পরে আমাদের ডাকে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছে। আর মুগ্ধ ভাই মারা যাওয়াটা সবার মধ্যে বিশেষভাবে এক ধরনের সাফ ফেলেছে। কারণ মুগ্ধ ভাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি উত্তেজিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাথে আমাদের অগণিত স্মৃতি রয়েছে। তাই বিষয়টা কেউ মেনে নিতে পারিনি।
আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল?
নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ জুলাই পর্যন্ত বেশ ভালো ছিল। তবে হল বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক দূরদূরান্তের শিক্ষার্থীদের থাকার কোন জায়গা ছিল না, সেক্ষেত্রে তাদের অংশ গ্রহণ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তবে, খুলনার অন্যান্য স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান-স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের ধারাবাহিকতা কীভাবে চলমান ছিল?
ধারাবাহিকতা বলতে গেলে প্রথমে ৪ জুলাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তীতে ৭ জুলাই আমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মানববন্ধন করি। এরপর ধীরে ধীরে আমরা ৮ থেকে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে জিরো পয়েন্টে মিছিল করি। পরবর্তীতে ১৬ জুলাই আমরা সাচিবুনিয়া মোড় ব্লক করি। পরবর্তীতে আমরা ডিসি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করি। এটা ১৬ বা ১৭ তারিখের দিকে হবে। এরপর ১৮ তারিখ থেকে বিভাগীয় দপ্তরে গিয়েও কথা বলি। সেখানে আমরা আমাদের দাবির কথা জানাই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ১৮ তারিখ হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় অর্ধেক স্টুডেন্ট চলে যায়। আমরা এমন কিছু স্টুডেন্ট ছিলাম যারা সম্মুখ সারির যোদ্ধা। হল ছেড়ে দিয়ে আমরা বিভিন্ন বন্ধুদের বাসায় থাকা শুরু করি। এরপর থেকে আমরা পরবর্তী প্রোগ্রামগুলো শিববাড়িতে করতে থাকি। শিববাড়িতে আমরা একটানা ২৬ তারিখ পর্যন্ত প্রোগ্রাম করি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দেওয়ার পর আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক ‘অদম্য বাংলা’র চোখ-মুখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিই। এটি ছিল আমাদের একটি প্রতীকী প্রতিবাদ।
পরবর্তী সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসে আমাদের গেট থেকে না বেরোনোর নির্দেশ দেয়। বলে যে, বের হলে গুলি করার নির্দেশ দেবে। সেখানে প্রায়ই এ ধরনের ভয় ও শংকার মধ্যে দিয়ে আন্দোলন চলমান থাকে। পরবর্তীতে ৩০ জুলাই আমরা শিববাড়িতে আন্দোলন করলাম। তখন পুলিশ এবং অন্য এক নিরাপত্তা বাহিনী দপ্তর থেকে ফোন আসে এবং ওইদিন সার্কিট হাউজে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ নির্যাতনের হুমকি দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। পরে ৩১ তারিখে আমরা সাত রাস্তার মোড়ে প্রোগ্রাম করি এবং সাত রাস্তার মোড় থেকে আমাদের ৬২ জনের অধিক গ্রেফতার হয়। সেখানে আমাদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং টিয়ারসেল ও বুলেট ছুড়ে। এতে সেখানে ৫০-৭০ জনের মতো আহত হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতদের ছাড়াতে গিয়ে থানায় আমাদের রাত কেটে যায়। পরবর্তীতে ২ তারিখে আমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্রোগ্রাম করি। সেখানে পুলিশ গুলি চালায়। সেদিনও আমাদের অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। পরবর্তীতে ৪ আগস্ট খুলনা স্বাধীন হয়।
আন্দোলনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কেমন ছিল?
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক বেশি ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি রেজাউল করিম স্যার, বর্তমান ডিএসএ নাজমুস সাদাত শুভ স্যার, হাসান মাহমুদ সাকি স্যার, আবুল বাসার নাহিদসহ এ রকম আরও অনেক স্যারদের সাপোর্ট আমরা পেয়েছি। ৩০ তারিখ যখন আমাদের গ্রেফতার করা হয়, তখন শিক্ষকরা থানায় এসেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনে শিক্ষকরা আমাদের সঙ্গে শামিল হয়েছেন। মানসিকভাবে আমাদের সাপোর্ট দিয়েছেন, কখনো কখনো আশ্রয়ও দিয়েছেন। তবে, এমন শিক্ষকের সংখ্যা ২০ থেকে ৫০ জনের মধ্যে ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন ছিল?
তাদের ভূমিকা আসলে ন্যাক্কারজনক ছিল। তারা আন্দোলনের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল। এমনকি মুগ্ধ ভাই মারা যাওয়ার পর ক্যাম্পাসে আমরা ঠিকমতো জানাজাও পড়তে পারিনি। গায়েবানা জানাজা পড়ার ক্ষেত্রে তারা সেন্ট্রাল মসজিদের ইমাম সাহেবকে ভয় দেখায়। এ কারণে জানাজাও সেভাবে পড়া হয়নি। তারা হল ছাড়তে বাধ্য করেছে, নানা ভাবে ভয়ভীতিও দেখিয়েছে।
আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিল?
তাদের ভূমিকা ন্যাক্কারজনক ছিল, এর তীব্র প্রতিবাদ আমি এখনও জানাই। যে প্রশাসন তার ছাত্র হত্যার জানাজা পর্যন্ত পড়তে দেয় না এবং উল্লেখ করতে পারে না যে কীভাবে শিক্ষার্থীরা মারা গেছে। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের গুলির ভয় দেখিয়ে হল থেকে বের করে দেয়, এই প্রশাসন আসলে কখনই ভালো হতে পারে না। আমরা দেখেছি যে আমাদের প্রশাসনের শিক্ষকরা সরকারের গোলাম হিসেবে কাজ করেছে।
খুলনায় আন্দোলনের মূল পয়েন্ট শিববাড়ি, জিরো পয়েন্ট, সাচিবুনিয়া ও নতুনরাস্তায় অবরোধ সফল হতো কীভাবে?
আমরা প্রতিদিন বসে প্ল্যান করতাম যে কীভাবে কর্মসূচি সফল করবো। আমরা শহরের মূল পয়েন্টগুলো আটকানোর চেষ্টা করতাম যাতে করে মিডিয়া এবং প্রশাসনের নজর কাড়া যায় এবং সারা বাংলাদেশ যাতে জানতে পারে যে খুলনাতেও জোরদার আন্দোলন চলছে। এছাড়া আন্দোলনের খরচের ব্যাপারে জানতে চাইলে আয়মান আহাদ বলেন, আমার এখনও মনে পড়ে যে আমি একদিন হঠাৎ করে অটোতে আসছিলাম। আমার মাথায় পতাকা বাধা দেখে এক লোক বললেন যে আপনি আন্দোলনে যাচ্ছেন? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি তখন বললেন যে, ‘আমি দুই হাজার বোতল পানি দেবো।’ এছাড়া আমাদের শিক্ষকরা আর্থিক সহযোগিতা করতেন যতটুকু পেরেছেন। বিভিন্ন মানুষ আমাদের সহায়তা করেছে। এছাড়া মাইক-ব্যানারের জন্য আমরা কিছু টাকাও তুলেছিলাম। আন্দোলনের পয়েন্টগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়ে লুকিয়েও যেতে হয়েছে। এছাড়াও যাওয়া-আসার পথে অনেক সময় অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। হামলার ভয়ও ছিল। সবকিছুকে ওভার কাম করেই আমাদের অবরোধ কর্মসূচি সফল করা হতো।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর সাথে সরাসরি কোন সংঘর্ষ হয়েছি কি না?
না, সেভাবে সরাসরি কোন সংঘর্ষ হয়নি। তবে ৩১ জুলাই সাতরাস্তার মোড়ে আমাদের কর্মসূচি চলাকালে ময়লাপোতার মোড় থেকে যুবলীগের একটি মিছিল হামলার জন্য আসছিল। কিন্তু তার আগেই পুলিশ আমাদের ওপরে হামলা চালায়। এতে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই এবং অনেকে গ্রেফতার হই।
আন্দোলন চলাকালীন আপনি কি ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন?
আমার প্রথম চিন্তা ছিল যদি সরকার পতন না হয় তাহলে হয়তো আমি গুমের শিকার হব। দ্বিতীয়ত আমার পরিবারের ইনফরমেশন তাদের কাছে ছিল- সেজন্য পারিবারিক চাপও ছিল এবং সর্বশেষ একটা পর্যায়ে জীবনের হুমকি ছিল। এছাড়া পড়াশোনা করতে পারবো না, আজীবন জেলে থাকতে হবে, এ ধরনের হুমকিও পেতাম। হুমকিগুলো প্রশাসনিক দপ্তর থেকেও আসে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়েছে কি-না?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে। যেমন আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন প্রধান উপদেষ্টা পেয়েছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে সর্বপ্রথম আমার প্রাধান্য ছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন। এক্ষেত্রে আমি তেমন কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। এছাড়া ব্যাংক খাতগুলোকে একটি ভালো অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা চলছে, রিজার্ভ বেড়েছে, দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচার কিছুটা হলেও কমেছে, বিদেশি ঋণ পরিশোধের হার বেড়েছে, বিশ্ব বাজারে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছে। বিশ্ব হয়তো নতুনভাবে বাংলাদেশকে দেখছে।
স্বৈরাচার পতন-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কী?
প্রত্যাশা একটাই, বাংলাদেশে আর যেন কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে- এ ধরনের একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আমি চাই যে শিক্ষিতরা যাতে রাজনীতিতে এগিয়ে আসেন। আমি দেশে ইতিবাচক রাজনীতি দেখতে চাই। যে রাজনীতি দেশ ও জাতির কল্যাণে এগিয়ে যাবে এবং আমি দেখতে চাই এ দেশে প্রকৃত শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণায় উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে।
সূত্র: বাসস