বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও অন্যান্য ফি কেমন হওয়া চাই
- মো. আশারাফ হোসেন
- প্রকাশ: ১১ জুন ২০১৯, ১০:৩২ PM , আপডেট: ১১ জুন ২০১৯, ১০:৪৮ PM
সরকার মালিকানাধীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষার্থী অধ্যয়নের সুযোগ সংখ্যা অপেক্ষা উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশী হওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। দেশে দুই দশক পূর্বে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপূরক হিসেবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সুযোগ তৈরী করা হয়।
বস্তুতঃ প্রধানত বাণিজ্যিক মানসিকতার ব্যবসায়ীরাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ গড়ে তুলেছে। তারা তাদের গঠিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ হতে অর্থ আয়ের মানসিকতা থেকে বের হতে পারেননি। ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের সুযোগ প্রদান করছে। প্রকৃতপক্ষে তারা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের ভর্তি করাতে অস্বীকার করেনা কিন্তু ভর্তি ও অন্যান্য ফি এতো বেশী উচ্চ হারে ধার্য করে যে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনা। সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায় যে, ক’জন ধনী ব্যক্তি মিলে পাঁচকোটি টাকা দিয়ে তথাকথিত মুনাফার জন্য নয় এমন ফাউন্ডেশন গঠন করে এবং উক্ত ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড় করায়। প্রায় সকল ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনের অর্থে অবদান রাখা ধনী ব্যক্তিরাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে যা বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্যবস্থাপনা করে থাকে। লক্ষণীয় যে, তারা পরোক্ষভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অর্থ আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের তৈরী বিশ্ববিদ্যালয় হতে কোন মুনাফা করেনা। তারা অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন উপায়ে নিয়ে থাকে। এমনকি মুনাফার জন্য নয় এমন এনজিও সমূহ যে সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সংগঠিত করেছে সেগুলোও শিক্ষার্থীদের নিকট হতে অত্যন্ত উচ্চহারে ভর্তি ও অন্যান্য ফি আদায় করে থাকে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, ধনী এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাই সেগুলোতে অধ্যয়ন করছে।
কিছু সংখ্যক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী যারা উচ্চশিক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে ভর্তি ও অন্যান্য উচ্চহারের ফি পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থা কিছুতেই কাম্য নয়। বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের কনভোকেশনে বারবার শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন উচ্চহারের ফি হ্রাস করতে আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু অবস্থা থেকে বোঝা যায় যে, তার আবেদন জলে গিয়েছে। ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ করে সরকার তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছে।
এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, অধ্যয়ন ও অন্যান্য ফি এমনভাবে ধার্য করা প্রয়োজন যাতে ধনী পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে সুযোগ পেতে পারে। অন্যথা হাজারো সুপ্ত প্রতিভার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা অর্জন হতে বঞ্চিত হবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি হ্রাস পাবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ যেন নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ফি ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের নিকট হতে আদায় করতে না পারে সেজন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় যে, স্নাতক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য সকল ফি, চার্জ ইত্যাদি মিলে টাকা ১০ হাজারের বেশী সংগ্রহ করা যাবেনা এবং মাসিক বেতন ইত্যাদি মিলে টাকা ১ হাজার ৫শ টাকার বেশী নেয়া যাবে না। স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য ভর্তি সর্বসাকুল্যে টাকা ১২ হাজারের বেশী শিক্ষার্থী প্রতি নেয়া যাবে না এবং মাসিক বেতন ইত্যাদি টাকা ২ হাজারের বেশী নেয়া যাবে না। এমন বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। আর এটা বাস্তবায়ন করতে হলে জাতীয় সংসদ হতে আইন করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে আইনগত কর্তৃত্ব প্রদান করতে হবে যাতে তারা রেগুলেটরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তবেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের পরিপূরক হয়ে উঠবে।
গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণার পূর্বে অর্থ মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন যে, মেডিক্যাল কলেজসহ সরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বেতন পাঁচগুণের বেশী বৃদ্ধি করা হবে এবং তা ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কার্যকর করা হবে। বাস্তবে ঘোষণাটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বেতন খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক ফি টাকা ১৬। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে দেশে সকল দ্রব্য ও সেবার মূল্য বহুগুণ মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। সম্ভবতঃ ছাত্র আন্দোলনের আশংকায় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে মাসিক টাকা ৩ হাজার হতে ৯ হাজার টাকা আদায় করে থাকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিংহভাগ শিক্ষার্থীই সচ্ছল ও ধনী পরিবারের সন্তান। তারা তাদের প্রতিভা বিকাশে বেশী সুযোগ পেয়ে থাকে। তারা সহজেই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ বেশী পায়। ফলে সচ্ছল ও ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাম মাত্র বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ পাচ্ছে। সরকারকে সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের বেশী সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব- সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক বেতন টাকা ১ হাজার ৫শ টাকা ধার্য করা প্রয়োজন। সে সঙ্গে অর্ধেক সংখ্যক শিক্ষার্থী যারা দরিদ্র পরিবার হতে আসবে তাদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ প্রদান করতে হবে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা প্রয়োজন।