শরীর নিজেই অ্যালকোহল তৈরি করে মাতাল হয় যে রহস্যময় রোগে

প্রতীকী ছবি - মদের বোতলে আটকে পড়া মানুষ
প্রতীকী ছবি - মদের বোতলে আটকে পড়া মানুষ  © গেটি ইমেজেস

সম্প্রতি চল্লিশোর্ধ্ব এক বেলজিয়ান ভদ্রলোক সংবাদের শিরোনাম হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। অ্যালকোহল পাওয়া যায় তার শরীরে—তাও নির্ধারিত সীমার তিনগুণ। অথচ তিনি এক ফোঁটা অ্যালকোহলও গ্রহণ করেননি।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় অবশেষে তিনি প্রমাণ করতে সমর্থ হন যে, তিনি মদ্যপান করেননি বরং ‘অটো ব্রুয়ারি সিনড্রোম’ নামে এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে শরীর নিজ থেকেই অ্যালকোহল উৎপাদন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনের একটি হাসপাতালের বিছানায় ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন রে লুইস নামের এক রোগী। দুটি বিষয় তাকে ভাবাচ্ছে, কিন্তু, সেগুলোর ব্যাপারে তার মনে কোনও সন্দেহ নেই, পুরোপুরি নিশ্চিত তিনি।

প্রথমটি, ১১ হাজার জীবন্ত স্যামন মাছসহ দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ট্রাকটির জন্য তাকে ভালোই বিপদে পড়তে হবে। মাছগুলো ফিস অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ ডিপার্টমেন্টের, তিনি সেখানকার একজন প্রযুক্তিবিদ।

আর দ্বিতীয়টি, যতই পুলিশের লোকেরা লিখুক না কেন যে, তার রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বেশি, দুর্ঘটনার রাতে লুইস মদ খাননি। সেই দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের এক রাতে।

রে লুইস বলছিলেন, “বরফ জমা রাস্তায় দুই ঘণ্টা ট্রাক চালাতে হবে, এটা তো আমি জানতাম। আমি এক ফোঁটা মদও ছুঁয়ে দেখিনি।”

দুর্ঘটনার আট মাস পর ৫৪ বছর বয়সী এই বায়োটেকনিশিয়ান জানতে পারলেন তার এবিএস আছে। আরো জানলেন, নিজের শরীরই তাকে মাতাল বানিয়েছে।

এবিএস কী?

এবিএসকে গাট ফারমেন্টেশন সিনড্রোমও বলা হয়। এটি দেহের এক রহস্যময় অবস্থা যা রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রোগী অল্প অ্যালকোহল গ্রহণ করুক কিংবা একেবারেই না গ্রহণ করুক নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

এই প্রক্রিয়ায় মুখ, পাকস্থলী বা মূত্রনালীর ব্যাকটেরিয়াগুলো চিনি ও অন্যান্য শর্করা গ্রহণ করে সেগুলোকে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত করে। প্রক্রিয়াটি এন্ডোজেনাস অ্যালকোহল প্রোডাকশন নামেও পরিচিত। এবিএসের প্রতিক্রিয়ায় কথা জড়িয়ে আসে, হাঁটাচলা এলোমেলো হয়ে যায় এবং হ্যাংওভার (অস্বস্তিকর অনুভূতি) হয়।

রোগটির অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ১৯৪০ এর দশকে যখন ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে উগান্ডার এক হাসপাতালের চিকিৎসকদের করা একটি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সী ছেলে শিশুটির পাকস্থলী ফেটে গিয়েছিল। পরিপাকতন্ত্রে সার্জারির সময় “একটা তীব্র গন্ধ পাওয়া যায়...যা স্পষ্টতই অ্যালকোহলিক বা মাদক সম্পৃক্ত।”

কারা আক্রান্ত হন?

এবিএস খুবই বিরল রোগ। ২০২১ সালে আমেরিকান জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে প্রকাশিত এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী—যুক্তরাষ্ট্রে এমন উদাহরণ একশটিরও কম। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, অনেক ঘটনাই আড়ালে রয়ে গেছে। রোগটির কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা।

পরিপাক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মানব শরীর পাকস্থলীতে কিছুটা অ্যালকোহল তৈরি করে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে রক্তে যাওয়ার আগেই ‘ফার্স্ট-পাস মেটাবলিজম’ নামে এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটুকু শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

“আমাদের সবার শরীরেই প্রাকৃতিকভাবে সামান্য অ্যালকোহল উৎপন্ন হয়। কিন্তু এবিএসে আক্রান্তদের শরীর খুব বেশি পরিমাণে এটি উৎপাদন করে যা রক্তপ্রবাহে মিশে যায়” ব্যাখ্যা করছিলেন ড. রিকার্ডো জর্জি দিনিস-অলিভিয়েরা, যিনি পর্তুগাল ভিত্তিক একজন বায়োমেডিক্যাল কনসালট্যান্ট ও ফরেনসিক এক্সপার্ট। এই রোগটি নিয়ে কয়েকটি গবেষণাপত্রও আছে তার।

“দুঃখজনক হলো, রোগটা যে আছে, এটা জানতে হলেও কাউকে ক্রিমিনাল চার্জের মতো নাটকীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।”

তার ভাষায় এবিএস একটা “পারফেক্ট মেটাবলিক স্টর্ম” বা বিপাকীয় বিপর্যয় যাতে কয়েকটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটতে শুরু করে।

প্রথমত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, আগে থেকেই ডায়াবেটিস, ওবেসিটি (স্থূলতা) বা অন্ত্রের প্রদাহের মতো রোগের উপস্থিতি থাকে।

দ্বিতীয়ত. রোগীরা কী ধরনের ওষুধ গ্রহণ করেন তার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত। যেমন – অ্যান্টিবায়োটিক বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এমন ওষুধ গ্রহণ করা, যেগুলো আমাদের পেটে থাকা ব্যাকটেরিয়া ও অনুজীবগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এবিএসের সঙ্গে বসবাস

পরিবারের সঙ্গে থ্যাংকসগিভিং ডিনারে ছিলেন জো কর্ডেল। ডিনারের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের এই নার্স। জ্ঞান হারানোর আগে যখন কথা জড়িয়ে আসছিল, তিনি ভেবেছিলেন টার্কি বেশি খেয়ে ফেলায় তার অসুবিধা হচ্ছে।

কিন্তু এরপর একদিন টেক্সাস হাসপাতালে শিফট চলাকালীন তার বিরুদ্ধে মাতাল হওয়ার অভিযোগ তোলেন এক সহকর্মী—যা রীতিমতো চাকরি যাওয়ার মতো অপরাধ। “লোকে ভাবতো আমি অ্যালকোহলিক,” ৭৫ বছর বয়সী কর্ডেল সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, “ওরা বলতো, আমার নিঃশ্বাসে মদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।”

“লজ্জিত আর বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে পড়লাম। আমি কাজপাগল মানুষ ছিলাম, একদিনও কামাই দিইনি।”

একটা সময় তার স্ত্রী ও সহকর্মী বারবারাও সন্দেহ করতে থাকেন যে তার মদ্যপানের নেশা আছে। স্বামীকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। ফলে সারা ঘর খুঁজতেন মদের বোতল লুকানো আছে কি না। এছাড়া ঘরে যা মদ ছিল সেগুলোর উপরও কড়া নজর রাখতেন বারবারা।

“প্রথমে আমি জোকে সন্দেহই করেছিলাম। ঘরে থাকা বোতলগুলোতে দাগ দিয়ে রাখতাম আমি। পরীক্ষা করে দেখতাম তাতে পরে পানি মেশানো হয়েছে কি না।” সন্দেহ আর অভিযোগের কারণে জো আতঙ্কে থাকতেন, কখন হুট করে তার মাতাল সময়টা চলে আসে! “এত বিরক্তিকর লাগতো, শারীরিক ও মানসিকভাবে ভয়ানক একটা সময় পার করতাম,” বলছিলেন তিনি।

উপসর্গ টের পাওয়ার বছর চারেক পরে ২০১০ সালে জো’র এবিএস শনাক্ত হয়। চাকরিটা বাঁচাতে সমর্থ হন ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করতে হতো তাকে।

এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে বারবারা একটি সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করেন। ‘অটো-ব্রুয়ারি সিনড্রোম অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসার্চ’ নামের প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা সাড়ে আটশোর কাছাকাছি। তিনি বলেন, “রোগীদের কাছে নিয়মিত শুনি ডাক্তাররা তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন।”

“আরো বাজে ব্যাপার হলো, তারা অপমানের শিকার হন, মিথ্যুক সাব্যস্ত হন এমনকি ভুয়া রোগ নিয়ে আসার অভিযোগও তোলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। আর নাহলে, নামমাত্র চিকিৎসা পান।”

তিনি আরও বলেন, যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান শুরুর পর তাদের অনেকে অ্যালকোহল উইথড্রোয়াল সিম্পটমের বিষয়ে বানিয়ে বলতে থাকেন।

“সময়ের সঙ্গে মদ্যপানে অভ্যস্ত এবং নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে ফিলিংস অফ উইথড্রোয়াল (নিজেকে সরিয়ে আনার অনুভূতি) এড়াতে চান তারা।”

“এক সময় অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হতো আমার, কিন্তু গত ১০ বছর ধরে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে পারছি।"

এবিএস কীভাবে শনাক্ত এবং চিকিৎসা হয়?
ডাক্তাররা প্রথমে উপসর্গগুলোর অন্য কারণ আছে কি না তা খতিয়ে দেখেন। তারপর রোগীর পরিপাকতন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় সেখানে অ্যালকোহল উৎপাদনকারী জীবাণু আছে কি না।

অনেক সময় গ্লুকোজ চ্যালেঞ্জ টেস্ট করা হয়। এই টেস্টে ব্যক্তিকে খালি পেটে শর্করাসমৃদ্ধ খাবার বা গ্লুকোজ গ্রহণ করতে বলা হয়। কয়েক ঘণ্টা পর পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যাদের এবিএস নেই তাদের রক্তে আলাদা করে অ্যালকোহল উপস্থিতি বোঝা যায় না বললেই চলে। কিন্তু, এবিএস থাকলে মাত্রাটা হয় অনেক বেশি।

ড. দিনিস-অলিভিয়েরা বলেন, কিছু ওষুধ ও কম শর্করা যুক্ত ডায়েট দিয়ে এবিএস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পাশাপাশি অন্ত্রে অনুজীবগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু ফুড সাপ্লিমেন্টও ব্যবহার করা হয়।

জো’র বেলায় এটা কাজে দিয়েছে। গত দশ বছরে একবারও মাতাল হননি তিনি। কিন্তু, লো-কার্ব ডায়েট ও মদ ছেড়ে দিলেও, কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় ভুগতে হচ্ছে রে লুইসকে। অবশ্য, ২০২০ সালের পর থেকে একবারও তিনি পুরোপুরি মাতাল হননি।

শারীরিক অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে রে লুইস আরেকটা কৌশল অবলম্বন করছেন। মিয়া নামের একটা কুকুর আছে তার। ল্যাব্রাডুডল প্রজাতির সেই কুকুরটিকে রে লুইসের শরীরের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘ্রাণ শুঁকে বোঝার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এমনকি ব্রুয়িং বা অ্যালকোহল তৈরি হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়েও মিয়া নামের কুকুরটি তা শনাক্ত করতে পারে।

কোনও পরিবর্তন টের পেলেই কুকুরটি তার সামনে দাঁড়িয়ে যায় এবং একনিষ্ঠ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। “মিয়াকে পাওয়ার আগে আমি পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বের হতাম না। সবসময়ই একটা ভয় কাজ করতো, হয় নিজের, না হয় অন্যের কোনও ক্ষতি করে ফেলি কি না,” বলছিলেন রে লুইস।

“দুর্ঘটনার সময় খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, আহত যা হওয়ার, আমি নিজে হয়েছি। অন্য কাউকে আঘাত করিনি।”

অনেকে নিজেদের শারীরিক অবস্থার উন্নতির প্রমাণ দিয়ে তাদের ড্রাইভ করার অধিকার ফিরে পেয়েছেন। রে লুইস ততটা ভাগ্যবান নন, গাড়ি চালানোর ছাড়পত্র মেলেনি তার। “বিচারক মনে করেছেন আমার শরীরের অ্যালকোহলের জন্য শেষ পর্যন্ত আমিই দায়ী,” বলছিলেন তিনি। “এটা একটা রোগ, কোর্ট যে রায়ই দিক, ন্যায়ের জন্য লড়াই করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই আমার।”

তিনি ও তার স্ত্রী সিয়েরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। এবিএসের উপস্থিতি আর আদালতের রায়ের জেরে চাকরিটা খোয়াতে হয় রে লুইসকে। কিন্তু, তিনি যেমন আশা হারাননি, হারিয়ে ফেলেননি সেন্স অফ হিউমার বা হাস্যরসের অনুভূতিও।

“অনেকে মনে করে এবিএসে আক্রান্তরা বিনা পয়সায় মাতাল হওয়ার অনুভূতি পায়। তাদের কী করে বোঝাই যে, আমি শুধু এর হ্যাংওভারটাই (অস্বস্তিকর অনুভূতি) পাই!” [বিবিসি]


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence