সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইসির সামনে যে ছয় চ্যালেঞ্জ

নির্বাচন কমিশন ভবন
নির্বাচন কমিশন ভবন  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে যাচ্ছে, যার ফলে ২০২৪ সালের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় ১৬ মাস পরে এসে আনুষ্ঠানিক চূড়ান্ত নির্বাচনী রোডম্যাপ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি আজ নির্বাচনের দিনক্ষণ জানিয়ে দেবেন। সরকারের আগের ঘোষণা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে এ নির্বাচন হওয়ার কথা।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং বেশিরভাগ দলই তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করার কাজ করছে। কোনো কোনো দল বেশিরভাগ আসনে প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করেছে।

এর মধ্যেই দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে কোথাও কোথাও উত্তেজনাকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তফসিলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে সব ধরনের অনিশ্চিয়তার আপাত অবসান হলেও এ নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে নির্বাচন কমিশন বা ইসিকে। কমিশন অবশ্য আগেই জানিয়েছে নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করেছে।

মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় কুড়িটি পরিপত্র জারি করবে কমিশন, যার লক্ষ্য হবে একটি সুন্দর নির্বাচন।

তারপরেও অন্তত ছয় চ্যালেঞ্জ

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনে ইসির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে একই দিনে দুটি নির্বাচন করা। অর্থাৎ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের আয়োজন করা।

তাদের মতে, এই দুটি বিষয়ের ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের গলদ হলে সেটি ভোটগ্রহণ ও গণনাকে সংকটের মুখে ফেলতে পারে এবং এ কারণে গণনায় অপ্রত্যাশিত বিলম্ব হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যেতে পারে।

আর এই এক দিনে দুই ভোট, ব্যালট ব্যবস্থাপনা ও গণনা ছাড়াও নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা, আইনশৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন এবং সামাজিক মাধ্যম ও এআই ব্যবহার জনিত চ্যালেঞ্জ কমিশনের সামনে বড় হয়ে উঠতে পারে ধারণা করছেন অনেকে।

এই এক দিনে দুই ভোট

নির্বাচন কমিশন আগেই জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের ব্যালটের জন্য আলাদা দুই রঙের কাগজ ব্যবহার করা হবে এবারের নির্বাচনে।

এর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সাদা কাগজে কালো প্রিন্টেড ব্যালট, আর গণভোটের ক্ষেত্রে রঙিন ব্যালট ব্যবহার করা হবে। রঙিন কাগজের ওপর যে কালি দৃশ্যমান হয় সে রকম কালিই ব্যবহারের কথা জানিয়ে রেখেছে ইসি।

যদিও ঢাকায় সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন নিজেই বলেছেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করতে ইসিকে অনেকগুলো অতিরিক্ত কাজ করতে হবে।

নির্বাচন বিষয়ক বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছেন, দুই ভোট একই দিনে হবে এবং প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে অন্তত ৮০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটি ভোটার ভোট দিতে পারেন।

'এর মানে হলো ২০ কোটি ব্যালট গুনতে হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সাত কোটি ভোটার ছিল, তাও গণনা শেষ হয়েছিলো ভোটের পরদিন সকালে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে এবার তো কয়েক দিন লাগবে,' বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তার মতে, বাংলাদেশ ভোট গণনায় দেরি হলে প্রার্থীরা অস্থির হয়ে ওঠে এবং এর জের ধরে অনেক সময় সহিংসতাও দেখা যায়।

'এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিষ্ণুতা কম। আমার মনে হয় সে কারণে ভোটগ্রহণের সময় ও ভোট গণনা দুটোই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে কমিশনের জন্য,' বলছিলেন মি. আলীম।

সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা জেসমিন টুলিও বলছেন, ইসি ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়েছে, কিন্তু এক ব্যালটে ভোট পড়তেই অনেক সময় লাগবে। কারণ, তার মতে গণভোটের ব্যালটের বিষয়গুলো পড়ে ভোট দিতে অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।

'এদেশে দল ও প্রার্থীরা ফলের জন্য অপেক্ষা করতে চায় না। এছাড়া অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। অনেক জায়গায় স্থাপনাগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী না। এমন পরিস্থিতি ভোট গণনায় রাত যত গড়াবে ঝুঁকি তত বাড়বে,' বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

ব্যালট ব্যবস্থাপনা ও আসন বিন্যাস

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এবার সারাদেশে ৩০০ সংসদীয় আসনে মোট কেন্দ্র থাকছে ৪২ হাজার ৭৬১টি। এসব কেন্দ্রে মোট বুথের সংখ্যা হবে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৯টি, যা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের চেয়ে কম। ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে ইসি কেন্দ্রের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করার কথা রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা এর আগে তফসিলের প্রস্তুতিপর্বে যে ধারণা দিয়েছিলেন, তাতে করে ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ব্যালট পেপারে সিল দেওয়া, সেটি ভাঁজ করা এবং বাক্সে ফেলার জন্য একজন ভোটার গড়ে সর্বোচ্চ সময় পাবেন ৫২ সেকেন্ড। এর মধ্যে নারী ভোটাররা গড়ে সময় পাবেন ৫৭ সেকেন্ড, আর পুরুষ ভোটার পাবেন ৪৮ সেকেন্ড।

এখন সংসদ নির্বাচনের দিন একসঙ্গে গণভোট হওয়ার কারণে এ সময়ের মধ্যেই একজন ভোটারকে দুই ব্যালটে তার ভোটদান শেষ করতে হবে।

আবার কমিশন যেভাবে কেন্দ্র ও বুথবিন্যাস করেছে তাতে একটি নারী বুথে ৫০০ জন, আর পুরুষ বুথে ৬০০ জন এবং একটি কেন্দ্রে তিন হাজার ভোটার ভোট দেবেন। এবারের নির্বাচনে ভোটের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে এবার সকাল সাড়ে সাতটায় শুরু হয়ে ভোটগ্রহণ শেষ হবে বিকেল সাড়ে ৪টায়।

এই সময়ের মধ্যে একটি নারী বুথে ৫০০ জন কিংবা একটি পুরুষ বুথে ৬০০ জন ভোটারের ভোট নেওয়া সম্ভব কি-না তা নিয়েও আলোচনা আছে।

আবার এবার পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন অনেক প্রবাসী। সেটি ব্যবস্থাপনাও কমিশনের জন্য নতুন একটি চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি।

ওদিকে তফসিল ঘোষণার পর আরও অনেক পরিপত্রের সাথে আসন বিন্যাসের পরিপত্রও জারি করবে কমিশন। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় কি-না তা নিয়েও উদ্বেগ আছে কারও কারও মধ্যে।

নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি

নির্বাচনকে সামনে রেখে দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ। দলটির নেতা ও কর্মীরা 'আওয়ামী লীগকে ছাড়া ভোট হতে পারবে না' এমন প্রচারণা চালাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে।

অন্যদিকে যেসব দল অংশ নিতে পারছে তাদের মধ্যে কোনো কোনো দলে প্রার্থিতা নিয়ে দলের ভেতরেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা যাচ্ছে। আবার নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিনিয়তই তিক্ততা বাড়ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে, যার ঢেউ ছড়াচ্ছে তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব আসবে নির্বাচন কমিশনের। জেসমিন টুলি বলছেন, এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন এবং যেসব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তার দীর্ঘদিন নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি।

'অথচ ভোটার বা প্রার্থীদের আশ্বস্ত হওয়ার মতো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। একটা ভালো নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী পরিবেশ যে পর্যায়ে আনা দরকার সেটা দ্রুতই হতে হবে,' বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সশস্ত্র বাহিনী

নির্বাচন সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের তথ্য অনুযায়ী নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে থাকবে তিন বাহিনীর ৯৪ হাজার সদস্য। এর মধ্যে ৯০ হাজার সেনাসদস্য, দুই হাজার ৫০০ জন নৌবাহিনীর সদস্য এবং এক হাজার ৫০০ জন‌ বিমানবাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে।

প্রতিটি উপজেলায় এক কোম্পানি সেনা মোতায়েন থাকবে বলে নভেম্বরের শুরুতেই তিন বাহিনী প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে জানিয়েছিলেন।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তফসিল ঘোষণার পরপর মোবাইল কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি নিয়োগ, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, মনিটরিং সেল গঠন, আইনশৃঙ্খলার সেল গঠনের মতো বিষয়গুলোতে ধারাবাহিকভাবে পরিপত্র জারি হতে থাকবে।

যদিও বিশ্লেষক জেসমিন টুলির মতে, আইনশৃঙ্খলা যে মাত্রায় উন্নীত হবার কথা সেটি এখনো হয়নি বলে তার ধারণা।

তবে তফসিল ঘোষণার আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কমিশনের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে না। ফলে আজ তফসিল ঘোষণার পর এ বিষয়ে কমিশন কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় সেদিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের।

দলগুলোকে সংযত রাখা

বাংলাদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীল আচরণের অভাব থাকার সমালোচনা আছে। অনেকের অভিযোগ, নির্বাচনে যে কোনো মূল্যে জয়ী হওয়ার একটি প্রবণতা আছে এদেশের ভোটের সংস্কৃতিতে।

আবার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামুলক না হলে এর প্রভাব পড়ে নির্বাচনী প্রশাসনে। একতরফা কিংবা কোনো দলের প্রভাব তৈরি হলে প্রশাসনের পক্ষেও আর নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখার সুযোগ হয় না বলে অনেকে অভিযোগ করেন।

'নির্বাচন ভালো হতে হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামুলক ও অংশগ্রহণমূলক হওয়া জরুরি। প্রার্থীরা সমান সমান না হলে পরিবেশ পলিউটেড হয়ে যায়। প্রশাসন তখন আর শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। কারণ তারা ধরেই নেয় একদল জিতবে এবং সেই দলের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দিলে পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে,' বলছিলেন জেসমিন টুলি।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেন ধৈর্য ধরে এবং নির্বাচনের ফল মেনে নেয়-সেই পরিবেশ তৈরির চ্যালেঞ্জ কমিশনকেই নিতে হবে।

সামাজিক মাধ্যম ও এআই

নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটের প্রচারণার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য আচরণ বিধিমালা জারি করেছে কমিশন।

এতে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট বা দল বা প্রার্থী সংশ্লিষ্ট সামাজিক মাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ইমেইল আইডিসহ অন্যান্য শনাক্তকরণ তথ্যাদি প্রচার-প্রচারণা শুরুর আগে রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করতে হবে।

আচরণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, প্রচার-প্রচারণাসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করা যাবে না। ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ভুল তথ্য, কারও চেহারা বিকৃত করা ও নির্বাচন-সংক্রান্ত বানোয়াট তথ্যসহ সব ধরনের ক্ষতিকর কনটেন্ট বানানো ও প্রচার করা যাবে না।

কিন্তু এগুলো কীভাবে মনিটর করা হবে তা এখনো পরিষ্কার নয় বলে বলছেন নির্বাচন বিষয়ক বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।

 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence