তদন্ত প্রতিবেদনে ‌‘দোষী’ ছাত্রদল, বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কার করল সাধারণ শিক্ষার্থীদের

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট)
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট)  © সংগৃহীত

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় ৫ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ছাড়া ৩২ জনকে সতর্ক করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সংঘর্ষের প্রকৃত দোষীদের আড়াল করে দুর্বল শিক্ষার্থীদেরই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষকরা এই বিচারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের লিখিতভাবে জানানো হয়। 

ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ও ছাত্রশৃঙ্খলা কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক বি এম ইকরামুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এমএসসি শিক্ষার্থী সালিম সাদমান এক বছরের জন্য এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওমর বিন হোসাইন, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শান্ত ইসলাম, মো. হৃদয় ও ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাফওয়ান আহমেদ ইফাজ ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার হয়েছেন। বাকি ৩২ জন শিক্ষার্থীকে সতর্ক করা হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ঘটনায় ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। চার সদস্যের ওই কমিটি তদন্তের পর প্রতিবেদন দাখিল করে। ২৫ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্রশৃঙ্খলা কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন, অভিযোগনামা, ভিডিও ফুটেজ, কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং তার উত্তর পর্যালোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়।

তদ্ন্ত প্রতিবেদনে ‌‘দায়ী' ছাত্রদল তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ, ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির তিনজন নেতার উপস্থিতিতে কুয়েটের একজন কলেজ শিক্ষকের ফার্মহাউজে ছাত্রদলের সদস্যপদ ফরম বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে কুয়েটের ২৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুষ্ঠান সংক্রান্ত ছবি প্রকাশিত হয়।

পরবর্তীতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা ভিসির কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ছাত্রদলের কর্মীদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, কুয়েটের পকেট গেট দিয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র, রামদা, চাপাতি ও লোহার রড নিয়ে প্রবেশ করে। তারা ছাত্রদলের কর্মীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এর ফলে মুহূর্তেই পুরো ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন প্রীতম বিশ্বাস, শাফি, নাফিস ফুয়াদ, সৌরভ, তাওহিদুল, ইউসুফ খান সিয়াম, দেবজ্যোতি, মাহাদি হাসান, নিলয় ও মমতাহিন।

১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের পর ২৫ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীরা এক দফা আন্দোলন ও অনশনের মাধ্যমে ২৫ এপ্রিল তৎকালীন উপাচার্যকে অপসারণের দাবি জানায়। ১ মে চুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. হযরত আলী ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৩৭ শিক্ষার্থী সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত হন। পরে ২৩ এপ্রিল পুনঃবিবেচনায় আনা হয়।

এদিকে কুয়েট শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের লাঞ্ছনার ঘটনার বিচারের দাবিতে দীর্ঘদিন ক্লাস বর্জন রাখেন শিক্ষকরা। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রক্রিয়া স্থবির থাকে। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদ হেলালী দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৯ জুলাই থেকে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। শৃঙ্খলা কমিটি পাঁচ শিক্ষার্থীকে শাস্তি এবং দুইজনকে সতর্ক করে।

কুয়েট শিক্ষক লাঞ্ছনা ঘটনার বিচারের পর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিচারিক প্রক্রিয়া ও সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। তারা উল্লেখ করেছে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েট ক্যাম্পাসে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় তৎকালীন প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করলেও প্রশাসন হল ভ্যাকেন্ট ঘোষণা ও তদন্তে গড়িমসি করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, দীর্ঘ দুই মাস ক্যাম্পাস বন্ধ থাকার পর তারা ফেরার পর অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গেলে তৎকালীন প্রশাসনের ইন্ধনে ২২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয় এবং ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে অন্যায়ভাবে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনায় আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং শিক্ষার্থীরা অনশনেও বসে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা উপস্থিত হন এবং ইউজিসি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী তৎকালীন উপাচার্য ও প্রো-ভিসিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, প্রশাসনের অসঙ্গত সিদ্ধান্ত ও শিক্ষক সমিতির টানা ক্লাস বর্জনের কর্মসূচির ফলে কুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় ছয় মাস স্থবির হয়ে পড়ে। সম্প্রতি নতুন উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার পর শৃঙ্খলা কমিটি ৫ জন শিক্ষার্থীকে প্যানাল্টি এবং ২ জনকে সতর্ক করেছে। তবে শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি বহিরাগত হামলার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও দোষীদের বিচার এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ২৮ ছাত্রদল কর্মীর নাম

এ বিচারের প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি জানান, প্রথমত, দ্রুত একাডেমিক রেজাল্ট প্রকাশ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ২৮ ফেব্রুয়ারির বহিরাগত হামলার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে; তৃতীয়ত, সেশনজটসহ শিক্ষার অস্বাভাবিক পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও তার ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে; চতুর্থত, ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বহিষ্কৃত ছাত্রদল সমর্থিত শিক্ষার্থী সাফওয়ান আহমেদ ইফাজ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি ছাত্রদলের সবকিছু আমি নিয়ন্ত্রণ করি এবং করেছি। তাই তারা টার্গেট করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার বিষয়ে। 

তিনি বলেন, ‘কুয়েটে তো অফিসিয়ালি ছাত্রদলের কোনো কমিটি নেই। তবে আমাদের কেউ কেউ হয়তো ছাত্রদলের সমর্থন করে। ওখান থেকে ২৩ জনের একটি তালিকা করা হয়েছিল। তবে এই আন্দোলনের মূল হোতাদের কাউকেই কোনো বিচারের আওতায় আনা হয়নি।’

কুয়েটে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী শান্ত ইসলাম। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা হিট অব দ্য মোমেন্টে যা করেছি, হয়তো সেটা অন্যায় হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারত। তা না করে সরাসরি আমাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।’

শান্ত ইসলাম আরও বলেন, ‘যদি শিক্ষক  লাঞ্ছনার ঘটনায় আমাদের শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের কেন কোনো বিচার হয়নি? আমাদের মনে হচ্ছে, আমাদেরকে ফাঁসানো হয়েছে। আমরা ৪ জন মিলে কিছু করতে পারতাম না। আমাদের শাস্তি দিয়ে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।’

কুয়েট শিক্ষক  লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. ফারুক হোসেন। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা সমগ্র ঘটনার বিচার চেয়েছি। কিন্তু এই বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকরা এই বিচারে অশন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যতটা ব্যাপকভাবে ঘটনাটি ঘটেছিল, ততটা পরিসরে বিচার হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু ক্যাম্পাস দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে পদ্ধতিতে বিচার করেছে, তা তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই করেছে ধরে নিয়ে আমরা আর এই বিষয়ে কথা বলছি না।’

শিক্ষক  লাঞ্ছনার ঘটনায় শাস্তি পাওয়া ৪ শিক্ষার্থীর বাইরে অন্য কেউ জড়িত ছিল কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’

ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ও ছাত্রশৃঙ্খলা কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক বি এম ইকরামুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষক সমিতির যে আন্দোলন চলছিল সেটি পুরো ঘটনার বিচার দাবিতে নয়, শুধুমাত্র শিক্ষকদের লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার চেয়েছেন তারা। তিনি আরও বলেন, ‘তবে ওই দিন শিক্ষার্থীদের ওপর কেন হামলা করা হলো, কেন বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করল এসব বিষয় এখনো বিচারাধীন। এখন পর্যন্ত শুধু শিক্ষকদের লাঞ্ছনার বিচার হয়েছে।’


সর্বশেষ সংবাদ