সার্চ কমিটিকে পাশ কাটানোর অভিযোগ
মন্ত্রণালয়ে বিএনপি নেতার বৈঠকের পর বগুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ
- মুহতাসিম মুনাওয়ার মুগ্ধ
- প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০৯ PM , আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫২ PM
আইন পাসের দীর্ঘ দুই যুগ পর সম্প্রতি বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। যদিও এরপর থেকেই নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে উঠে আসছে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ। সূত্র বলছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ একটি বৈঠক করে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। উপাচার্য নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটিকে পাশ কাটিয়ে বগুড়া জেলা বিএনপির এক সহ-সভাপতির সুপারিশে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে; যেখানে বাদ পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেড–১ এর একজন অধ্যাপক। অন্যদিকে চূড়ান্ত নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেড–২-এর একজন শিক্ষক। কেন কমিটির কনসার্নের বাইরে গিয়ে এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ— বিষয়টি সম্পর্কে জানতে সার্চ কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘এটা মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।’
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলামের কক্ষে বিএনপি নেতার অংশগ্রহণে একটি ‘বিশেষ বৈঠক’ অনুষ্ঠিত হয়; যেখানে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী, বগুড়া জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মীর শাহে আলম উপস্থিত ছিলেন। এতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এগ্রোনমি এন্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হককেও ডাকা হয়েছিল। সূত্রের অভিযোগ, ওই বৈঠকেই রাবি অধ্যাপক ড. কুদরত-ই-জাহানকে উপাচার্য হিসেবে ‘সিলেক্ট’ করা হয়। আর সিনিয়র অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হককে প্রস্তাব দেওয়া হয় উপ-উপাচার্য হতে। তবে নিজের চেয়ে ১২ বছরের জুনিয়রকে উপাচার্য করায় অধ্যাপক আমিনুল হক উপ-উপাচার্য হওয়ার ওই প্রস্তাবে রাজি হন না। এমনকি অধ্যাপক ড. আমিনুল হক যেন মন্ত্রণালয়ে (উপাচার্য পদে) জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে না পারেন, সেজন্য তার সিভির প্রথম পাতা ছিড়ে ফেলেন নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোাহ. হাছানাত আলী।
অভিযোগ রয়েছে, অধ্যাপক হাছানাত আলীও বগুড়া জেলা বিএনপির ওই নেতার আশীর্বাদে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি), এমনকি চেয়ারম্যানের কক্ষেও এই দুজনকে একসঙ্গে দেখা গেছে— এমনটাই জানিয়েছেন ইউজিসি সংশ্লিষ্ট প্রথম সারির এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ উত্তরবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রভাব বিস্তার করতে একটি বলয় গড়ে উঠেছে; যেখানে একটি পক্ষ থেকে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে নানাভাবে প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করছে। বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও মন্ত্রণালয়ে সেটি হয়ে থাকতে পারে।
এদিকে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুল হকের একাডেমিক যোগ্যতা কম থাকায় উপ-উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে ড. কুদরত-ই-জাহান অনেক যোগ্য হওয়ায় তাকে উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল।’ বৈঠকে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মীর শাহে আলম এবং নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হাছানাতের উপস্থিত থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন আমার সঙ্গে অনেকেই দেখা করতে এসেছিল। সেদিন কারা সেখানে উপস্থিত ছিল বিষয়টি আমার মনে পড়ছে না।’
বিষয় সম্পর্কে জানতে অধ্যাপক আমিনুল হকের সঙ্গে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের কথা হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১৬ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী আমাকে ফোন করে মন্ত্রণালয়ে দেখা করতে বলেন। ১৭ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে আমিনুল ইসলামের রুমে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী এবং বিএনপি নেতা মীর শাহে আলমও ছিলেন। সেখানে আমাকে উপ-উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব করা হয়। তবে আমি নাকচ করে দেই। কারণ, সেখানে আমার চেয়ে ১২ বছরের জুনিয়রকে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছিল। অধ্যাপক হাছানাত আমার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে ওপরের পৃষ্ঠা ছিড়ে ফেলেছিলেন; যেখানে আমার সব অর্জন লেখা ছিল।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হাছানাত আলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি এবং বিএনপি নেতা মীর শাহে আলম সেখানে ছিলাম। সেখানে কোনো বৈঠক হয়নি। আমরা আমিনুল হকের সিভি কেন ছিড়ব। এটা কি উনি দেখাতে পারবেন? যদিও বিএনপি নেতাসহ কেন তিনি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর রুমে গিয়েছিলেন, এ বিষয়ে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বিএনপি নেতা মীর শাহে আলম (সর্ব ডানে)। পাশে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হাছানাত,
রাবি অধ্যাপক আমিনুল হক, রাবি অধ্যাপক জিএম শফি এবং জাহাঙ্গীর বাবু
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলার প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। জেলা থেকে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে পার্শ্ববর্তী জেলার প্রার্থীদের বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বগুড়ার বাসিন্দা অধ্যাপক আমিনুল হক উপাচার্য পদপ্রত্যাশী এবং গ্রেড–১-এর শিক্ষক হলেও তাকে বাদ দিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেড–২-এর শিক্ষক নওগাঁ জেলার অধ্যাপক কুদরত–ই–জাহানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। উচ্চপর্যায়ের সুপারিশের কারণে এ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। সার্চ কমিটি গঠন করা হলেও কার্যত সেটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।’
জানতে চাইলে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কুদরত-ই-জাহান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকার আমাকে সকল নিয়ম মেনে নিয়োগ দিয়েছে। যদি নিয়োগে কোন অনিয়ম হয়ে থাকে সেটা সরকার ভালো বলতে পারবে। এটা আমার জানার কথা নয়। সরকার আমাকে যোগ্য মনে করেছে, তাই ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
আপনার চেয়ে ১২ বছরের বেশি অভিজ্ঞ শিক্ষক বগুড়ায় ভিসি ক্যান্ডিডেট ছিলেন, তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আপনি গ্রেড-২ এর শিক্ষক হয়েও কীভাবে ভিসি পদে নিয়োগ পেলেন এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক কুদরত-ই-জাহান বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রেড-১ শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ২৫০ জন। অধ্যাপক আমিনুল হক স্যার অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি। অবশ্যই তার ভিসি হওয়ার যোগ্যতা রয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে আমাকে কেন ভিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হলো সেটি সরকার ভালো বলতে পারবে।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা প্রসঙ্গে জানতে বগুড়া জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মীর শাহে আলমের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বগুড়ায় ভিসি নিয়োগে সার্চ কমিটিকে পাশ কাটানোর নজির
গত ১৯ মে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রণয়নে সার্চ কমিটি গঠন করে সরকার। শিক্ষা উপদেষ্টাকে সভাপতি করে গঠিত এ কমিটি ইতোমধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তবে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েল ক্ষেত্রে সার্চ কমিটিকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের জন্য কোনো বিজ্ঞপ্তি জারি হয়নি, জীবনবৃত্তান্তও সংগ্রহ করা হয়নি। যদিও সার্চ কমিটি গঠন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পরবর্তীতে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করার কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে জীবনবৃত্তান্ত বাছাই পূর্বক নিয়োগ সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয়নি।
যদিও সার্চ কমিটিকে পাশ কাটানোর বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, ‘কে ভিসি হবেন আর কে হবেন না সে বিষয়ে সার্চ কমিটি কেবল সুপারিশ করতে পারে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। বগুড়ায় কীভাবে ভিসি নিয়োগ হয়েছে সেটি মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ হয়েছে, সেটি আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নিতে হবে।’
ভিসি নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বগুড়ায় মানববন্ধন
বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করেছেন বগুড়ার সচেতন নাগরিক ও শিক্ষার্থী সমাজ। গত ১৪ জুলাই বিকেলে শহরের সাতমাথা জিরোপয়েন্টে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
মানববন্ধনে আয়োজকরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নিয়ম অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট জেলার একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ নাগরিককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও, বগুড়ার একজন গ্রেড-১ এর সিনিয়র শিক্ষকের পরিবর্তে নওগাঁ জেলার গ্রেড-২ এর একজন শিক্ষককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বক্তারা অভিযোগ করেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা জড়িত রয়েছেন। তারা অবিলম্বে নিয়োগ বাতিল করে বগুড়ার একজন সিনিয়র ও যোগ্য নাগরিককে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের দাবি জানান।