নিজেরাই নেতা ঘোষণা করে সাংবাদিক সমিতি দখলের চেষ্টা ছাত্রলীগের মদদপুষ্টদের

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © সংগৃহীত

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) সাংবাদিক সমিতি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডার এবং মদদপুষ্টদের অবৈধভাবে দখলের অভিযোগ উঠেছে। নিজেরা নিজেদের নেতা বানিয়েছে। সাংবাদিক নয় এমন শিক্ষার্থীদেরও সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে পতিত স্বৈরশাসকদের দোসর হিসেবে পরিচিত শিক্ষকদের একাংশের ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন না দিয়ে, আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপদেষ্টাদের না জানিয়ে ৮ নভেম্বর অবৈধভাবে কমিটি দেয় আগের কমিটির সভাপতি ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মাউথপিস হিসেবে পরিচিত শুভ দে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র আন্দোলন দমন ও স্বাক্ষর জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে শুভ দের বিরুদ্ধে।

এ নিয়ে শনিবার (৯ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও মাভাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির উপদেষ্টা বরাবর প্রমাণাদিসহ অভিযোগ দিয়েছেন ক্যাম্পাসে কর্মরত সাংবাদিকরা। অভিযোগে অবৈধ কমিটি প্রদানকারী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বিরোধিতাকারী ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডার নিয়ে গঠিত কমিটি বাতিল করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।

অভিযোগ ও মাভাবিপ্রবির বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতে সংগঠনটির ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে প্রকাশিত কমিটি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মাউথপিস ও সমিতির সাবেক সভাপতি শুভ দের স্বাক্ষরে প্রদান করা হয়। ১৩ সদস্যের ওই কমিটির সভাপতি অর্থনীতি বিভাগের বিজয় সরকার ও সাধারণ সম্পাদক একই বিভাগের জাহিদ হাসান বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: রজতজয়ন্তী পেরিয়ে ২৬ বছরে পদার্পণ করল মাভাবিপ্রবি

কমিটি প্রদানকারী শুভ দে ও তার সহযোগী বিজয় সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মাভাবিপ্রবিতে আন্দোলন বন্ধ করতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ভূমিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুনের যোগসাজশে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তৌকিরকে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে নিয়ে যায় এই শুভ দে ও বিজয় সরকার। তৌকিরকে বিভিন্নভাবে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে চাপ দেয় তারা।

অডিও এক কথোপকথনে তৌকিরকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ‘ও (শুভ দে) খালি আমারে বলত, আমার চাকরিতে প্রবলেম হইব ভাই, আপনি একটু এইটা (আন্দোলন প্রত্যাহার) করেন। আপনিও সেভে আসেন। তখন যে সরকার পতন হইবো এটা কে জানত।’ পরে আন্দোলন স্থগিতে প্রেস রিলিজ শুভ দে নিজে লিখে টাঙ্গাইলের সব সাংবাদিক ও এসপি অফিসে পাঠান।

অভিযোগ রয়েছে, শুভ দে নিজেকে বিভিন্ন জনের কাছে ছাত্রলীগের মাউথপিস হিসেবেও পরিচয় দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতেন। বিজয় সরকারকেও দেখা গেছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে।

এ ছাড়া নতুন প্রকাশিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসানের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক ছাত্রসংগঠন করার অভিযোগ। এই শিক্ষার্থী ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ মাভাবিপ্রবি শাখার সর্বশেষ কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এর বাইরেও শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুনের হয়ে ছাত্রলীগের সম্মেলনে উপস্থিত থাকতেও দেখা গেছে তাকে। এ ছাড়া অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তার নেই কোনো নিবন্ধিত পত্রিকা।

আরও পড়ুন: মাভাবিপ্রবিতে আইসিটি বিভাগের অ্যালামনাই পুনর্মিলনী উদযাপন

মাভাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির গঠনতন্ত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এটি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। একই সঙ্গে কেউ সংগঠনটিতে যুক্ত হওয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে তিনি সমিতি থেকে বহিষ্কৃত হবে। এ ছাড়া সদস্য হতে গেলেও নিবন্ধিত পত্রিকার প্রতিনিধি হতে হবে। কমিটি দেওয়ার ক্ষেত্রেও নির্বাচনের বিধান রয়েছে। এসবের কোনোটিই মানা হয়নি বলে অভিযোগ করেন মাভাবিপ্রবিতে কর্মরত নিবন্ধিত পত্রিকার সাংবাদিকরা।

অভিযোগকারীরা জানান, মাভাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির নতুন কমিটি গঠনে নির্বাচন না হলেও সবার মতামতের ভিত্তিতে এবং উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কমিটি প্রস্তাব করা হয়েছে বিগত সময়ে। অথচ যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে সাধারণ সম্পাদকসহ অধিকাংশ নিবন্ধিত পত্রিকার সাংবাদিকদের তো জানানো হয় নি, উপদেষ্টারাও এ বিষয়ে অবগত নন।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, নতুন কমিটির সহসভাপতি হৃদয় হোসাইন শুভ দের কথায় নিজেকে এত দিন ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দাবি করতেন। অথচ সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো লিগ্যাল নথি নেই। তার সংযুক্ত পত্রিকার কোনো নিবন্ধনও নেই।

আরেক সহসভাপতি ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টাল ভার্সিটি ভয়েসের প্রতিনিধি উল্লেখ করে সহসভাপতি পদে ছাত্রলীগ কর্মীকে পদায়নের অভিযোগ করা হয়েছে। এ ধরনের কোনো অনলাইন পোর্টালের বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছাত্রলীগ‌ ক্যাডার আতিকুল ইসলামকে পদায়ন করা হয়েছে।

কমিটিতে দেখা যায় নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়াকে ফটোসাংবাদিক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এমন পদ শুধু মাভাবিপ্রবি নয়, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সংগঠনে নেই।

আরও পড়ুন: মাভাবিপ্রবির প্রশাসনিক দায়িত্বে ৬ নতুন মুখ

শুভ দে ও বিজয় সরকারের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগও আনা হয়েছে। এ বিষয়ে পত্রে বলা হয়, বিগত প্রশাসনের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে সুবিধা ভোগ করলেও নিজেদের পুরোপুরি উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়ায় তারাসহ ১৪ জনের অধিকাংশকে মূল বিষয় না জানিয়ে ফাঁকা কাগজে স্বাক্ষর নেন। সেই স্বাক্ষর দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সাবেক জনসংযোগ পরিচালক ও কম্পিউটার অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয়। পরে স্বাক্ষর করা অনেকেই অভিযোগের বিষয়টি অবগত হলে, কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ তুলে নেন এবং প্রশাসনকে দেওয়া আবেদনে উল্লেখ করে, তাদের সাংবাদিকতার বিষয়ে অভিযোগের কথা বলে স্বাক্ষর নেওয়া হলেও দেওয়া হয় অন্য অভিযোগ।

স্বাক্ষর জালিয়াতির এমন কাজ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে উল্লেখ করেন সাংবাদিকরা। এতে আরও বলা হয়েছে, ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মীদের সাংবাদিক সমিতিতে নিয়ে আসা হয়েছে। ২০২৪ এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ডায়েরিতে সাংবাদিক সমিতির সদস্যদের নামের তালিকা দেয় শুভ দে। যেখানে আগের কমিটির তেমন কেউ তো ছিলই না বরং ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী এবং প্রায় ৫০ শতাংশ হিন্দু শিক্ষার্থীকে সাংবাদিক হিসেবে নাম দেন। তালিকায় সর্বশেষ কমিটির সাধারণ সম্পাদকের নামও ছিল না।

এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে নতুন অবৈধ কমিটির ১৩ জনের অধিকাংশই সাংবাদিক নয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, আগের কমিটিগুলোয় প্রক্টর মহোদয়ের স্বাক্ষর থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবগত না করেই অবৈধ উপায়ে কমিটি দেওয়া হয়েছে। দেশবিরোধী এমন কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার এবং প্রশাসনকে না জানিয়ে অবৈধভাবে কমিটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অবৈধ কমিটির প্রচারে কাজে লাগানো হচ্ছে ছাত্রলীগের সাবেক কর্মীদের। এর মধ্যে রয়েছে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তারেক ও পরিসংখ্যান বিভাগের পিয়ালসহ আরও অনেকে।

দেশবিরোধী এসব অপরাধীর অবিলম্বে শান্তি চেয়ে অবৈধ কমিটি বিলুপ্ত করে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন কমিটি প্রদানে বিশ্ববিদ্যালয় ও উপদেষ্টাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: মেধায় চূড়ান্ত ভর্তির পর মাভাবিপ্রবিতে আসন ফাঁকা ৫৬

এ বিষয়ে মাভাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. নূর এ আলম নুহাশ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে বিরোধিতাকারী, রাজনৈতিক সংগঠন ও স্বাক্ষর জালিয়াতিতে জড়িত এবং অসাংবাদিক এই ১৩ সদস্যের কারোর ন্যূনতম সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু এত বড় বিপ্লবের পর ছাত্র-আন্দোলন বন্ধের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড শুভ দে ও বিজয় সরকার অবৈধভাবে এই অপতৎপরতা দেখিয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট, অবৈধ উপায়ে তারা ফ্যাসিস্টদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। কিছু শিক্ষক তাদের ইন্ধন দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এই জঘন্য কাজ শুধু এই সংগঠন নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশকেও কলুষিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা আইনি লড়াইয়ে যাব এবং অভিযুক্তদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়েও প্রতিহত করব।’

অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. ইমাম হোসেন বলেন, ‘খুবই ব্যস্ত সময় পার করছি। তাই এখনো পর্যালোচনা করিনি। তবে যদি কেউ দোষী হয়ে থাকে তবে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ এখানে কোনো কার্যক্রমের সুযোগ পাবে না।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence