নানা সমস্যায় জর্জরিত যবিপ্রবির ভেটেরিনারি অনুষদ

পূর্বের ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ, বর্তমান যবিপ্রবি ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ
পূর্বের ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ, বর্তমান যবিপ্রবি ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ  © সংগৃহীত

নানা সমস্যায় জর্জরিত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ। চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজকে যবিপ্রবির অনুষদ হিসেবে যুক্ত করা হয়।
 
তবে প্রায় ৩৬০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র ২ জন স্থায়ী শিক্ষক, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের অনুপস্থিতি, ২ বছরের সেশনজট, ১৫টি ল্যাবের ১ জন ল্যাব টেকনিশিয়ান, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এই অনুষদ। 

ফলে গুণগত মানের শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। স¦য়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসনের পরও দীর্ঘ ৯ মাসে সংকট সমাধান না হওয়ায় অনুষদটির শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন।

বর্তমানে যবিপ্রবির এ অনুষদটিতে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত সাতটি ব্যাচে প্রায় ৩৬০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন। এর বিপরীতে স্থায়ী শিক্ষক আছেন মাত্র ২ জন যারা প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভেটেরিনারি সার্জন। নেই কোন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক কিংবা সহকারী অধ্যাপক। 

শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের অনুপস্থিতি, সেশনজট চরমে থাকায় সাতটি ব্যাচ চলমান, ১৫ টি ল্যাবের একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান, কোটি টাকা মূল্যের গবেষণা সরঞ্জামের নেই ব্যবহার, মেয়াদীত্তোর্ণ কেমিক্যালস, মেডিকেল সেন্টার বন্ধ, নেই ডাক্তার-ঔষধ-এ্যাম্বুলেন্স—এমন নানা সমস্যায় জর্জরিত যবিপ্রবি ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জেলা ও উপজেলা ভেটেরিনারী সার্জন, প্রভাষক ও অতিথি শিক্ষক সহ মোট ২২ জন শিক্ষক ও ৫২ জন কর্মচারী আছেন। শিক্ষক সংকটের কারণে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারেনি যবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষেও ভর্তি করানো নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তীব্র সেশনজট, রাজনৈতিক গ্রুপিং-অস্থিরতা সহ নানা ধরনের সমস্যায় আচ্ছন্ন এ অনুষদ।

এদিকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন। বাকি কর্মচারীরা এলাকার প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ লোক পরিচয়ে কর্মক্ষেত্রে অনিয়মিত। নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা কখনো কর্মক্ষেত্রে আসেন না। ফলে পুরো ক্যাম্পাসটির চারিদিকে ঝোপ-ঝাড় ও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে। 

আরও পড়ুন: মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি বেরোবি ছাত্রলীগের কমিটি

বিশ্বমানের ডিভিএম গ্রাজুয়েট তৈরীর লক্ষ্যে হাতে কলমে শিক্ষার জন্য ল্যাবগুলোতে আনা অতি দামী কেমিক্যালসগুলো ব্যবহারে দক্ষ জনবলের অভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগেই; যার সবগুলোর মোড়কই খোলা হয়নি।

এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্যাম্পাসটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট চরমে। স্থানীয় রাজনীতির কারনে একাধিকবার ক্যাম্পাস বন্ধ হয়েছে। ২০১৯ সালে অনুষদটির ছাত্রলীগের দু-গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ৬ জন আহত হয়েছিলো। এরপর ২০২২ সালে ঝিনাইদহে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলে জেরে হামলায় তৎকালীন ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজের ভিপি মুরাদ বিশ্বাস, ছাত্রলীগ কর্মী তৌহিদ ও সমরেশ হোসেন ছমির নিহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগের আরেক নেতাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। 

ইউজিসি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতায় যবিপ্রবি ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের সংকট নিরসনে লাগছে বাড়তি সময়যবিপ্রবি উপাচার্য আনোয়ার হোসেন

এছাড়া ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব, গ্রুপ ভিত্তিক মারামারি, সাইবার বুলিং, যৌন হয়ারানি, হল দখলসহ অভিযোগের শেষ নেই। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে যবিপ্রবি উপাচার্য গত ৯ জুলাই অনুষদটির সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম (সভা, সমাবেশ, মিছিল, রাজনৈতিক পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড স্থাপন ও প্রদর্শন) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

ভেটেনারী অনুষদের শিক্ষার্থী সোহান শেখ বলেন, ভেটেরিনারী মেডিসিনের মতো টেকনিক্যাল বিষয়ের জন্য মাত্র দুই জন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছেন বাকিরা সবাই গেস্ট টিচার হিসাবে ক্লাস নিচ্ছেন। এখানে প্রায় ৭/৮ টি ব্যাচের ক্লাস পরীক্ষা চলমান যা প্রায় অসম কয়েকটি ব্যাচ একসাথে চলছে। ২ জন মাত্র শিক্ষক এর মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাচের একইসাথে ক্লাস পরীক্ষা চালানো প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে ল্যবগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রিএজেন্ট নেই। যেগুলো আছে সেগুলোও মেয়াদোত্তীর্ণ।

তৃতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাকিম আহমেদ বলেন, এই অনুষদের মেডিকেল সেন্টারে কোন ডাক্তার বা ঔষধ নেই। এছাড়াও এম্বুলেন্সের কোন ব্যাবস্থা নেই। কোন শিক্ষার্থী হঠাৎ অসুস্থ হলে তাকে ৯ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লাগে। এখানে পোলট্রি শেড থাকলেও এ পর্যন্ত কোন পোলট্রি আসেনি। ফলে আমরা এ ব্যাপারে শিক্ষাগ্রহণে বঞ্চিত হচ্ছি। ইতিপূর্বে রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারনে সেশনজটে পড়তে হয়েছে যার সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। আমরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। মাননীয় উপাচার্য স্যারের নিকট সকল সমস্যা সমাধানের আবেদন করছি।   

যবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সমন্বয়ে আমরা ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজকে যবিপ্রবির অনুষদ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করি। কিন্তু ক্লাস-পরীক্ষা ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব এখনো বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। পূর্নাঙ্গরূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ হওয়ার জন্য অনেক কাজ বাকি। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকবল নিয়োগ দিতে হবে; শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নির ব্যবস্থা করতে হবে। এ সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ক্যাম্পাসকে পুরোপুরি যবিপ্রবির নিকট জমি জায়গাসহ হস্তান্তর করতে হবে তারপর বাজেট প্রণয়ন সহ বাকী কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। 

তিনি আরো বলেন, যোগ্যতাসম্পন্ন নতুন শিক্ষক নিয়োগ না দিতে পারলে আমরা নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়াও শুরু করতে পারছি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকার পরেও কেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি দ্রুত কার্যক্রম শুরু করছে না তা আমার বোধগম্য নয়। ইউজিসি যেহেতু এখানে সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করছে সেহেতু তারা যতদ্রুত এ সমন্বয় করতে পারবে ততদ্রুত আমরা জনবল নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে পারবো। 

সেশনজট নিরসন, আধুনিক গবেষণা ও মানসম্মত গ্রাজুয়েট তৈরীর বিষয়ে উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, এটি যখন সম্পূর্ণরুপে আমাদের কাছে হস্তান্তরিত হবে তখন আমরা অনুষদটিকে একটি ভেটেরিনারি শিক্ষার আধুনিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলবো। যবিপ্রবি সর্বদা মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী। সুতরাং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি দ্রুত আমাদেরকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পর্যাপ্ত বাজেট দিলেই সেশনজট নিরসনসহ নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি ও সার্বিক বিষয়ে ২/৩ মাসের মধ্যেই সবকিছু শুরু করতে পারবো বলে আশা করি।


সর্বশেষ সংবাদ