ভাড়া দেওয়াশেষে রিকশাওয়ালাকেও ধন্যবাদ দিতো ফারদিন

সাজ্জাদ হোসাইনের সঙ্গে রিকশায় ফারদিন নুর পরশ
সাজ্জাদ হোসাইনের সঙ্গে রিকশায় ফারদিন নুর পরশ  © সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নুর পরশ হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত প্রায় ডজনখানে অপরাধীকে আটক করা হয়েছে। মূলত ফারদিন হত্যায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যেতে পারে বলেই আটক করা হয়। চলমান এ পরিস্থিতির মাঝে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিশা নামে ফারদিনের এক বান্ধবীর পোস্টের পর এবার সাজ্জাদ হোসাইন নামে এক বড় ভাইয়ের আবেগঘন স্ট্যাটাস ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

সাজ্জাদ হোসাইন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী। সাজ্জাদের এ পোস্টে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এবং কয়েকশ মানুষ শেয়ার করেছেন।

পাঠকদের জন্যে পোস্ট হুবহু তুলে ধরা হলো- ‘‘ফারদিন নুর পরশের মৃত্যুকে কিছু কিছু খবর যেভাবে প্রচার করছে, সেইগুলো পড়ে আমার বারবার পরশকে মনে পড়ে যাচ্ছে। এমন নানান খবর ও প্রচারণা নিয়ে আমরা একসাথে হাসাহাসি করতাম, মশকরা করতাম। একে অন্যকে বলতাম, ‘দেখ, কতো রামছাগলে ভরে গেছে দ্যাশ।’ এখন আমার এই হাসি কৌতুক সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু অন্তত পরশের ব্যাপারে না জেনে যাতে কেউ বাজে কোনো মন্তব্য না করে, তাই এই পোস্টখানা লিখছি।

পরশ যখন ষষ্ঠ থেকে সপ্তম ক্লাসে উঠে, তখন আমি সদ্য জেএসসি শেষ করে নবম ক্লাসে ভর্তি হই। সে আমার দ ‘বছরের ছোটো। প্রথমবার দেখা হয় বাসার নিচে ক্রিকেট খেলায়। আমি এলাকায় নতুন ছিলাম, সে ছিল পুরাতন। স্বভাবতই আমি একা ছিলাম, তার ছিল ছোটো আরও দুই ভাই, আর বন্ধু-বান্ধব। কিন্তু প্রথমবারই সে আমাকে একটা ওয়ার্ম-ওয়েলকাম জানায় তাদের টিমে। প্রথম দিন থেকেই আমি তাদের একজন হয়ে যাই। খেলাধুলা করি।

তাদের বাসায় যেয়ে দেখি শেলফ ভর্তি বই। এর বাহিরে তার আনুমানিক তিন বস্তা বই ছিল। তার সময় কাটে না, কারণ সব বই দুই থেকে তিনবার করে পড়া শেষ, নতুন পড়ার কিছু নাই। পরশের আব্বু বাসায় তাদের জন্য কিছু আনুক না আনুক, টানাপোড়েনের সংসারে নিত্যনতুন বই নিয়ে আসতে ভুলতেন না। আমাদের বাসার পুরাতন পত্রিকা নিয়ে সে প্রতিটি বর্ণ পড়তো, কিন্তু তার পড়ার ক্ষিধে মিটে নি কখনও।

আরও পড়ুন: বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যার নেপথ্যে রায়হান গ্যাং

এরপর একসাথে বড় হয়েছি, মানসিক বিকাশও একই সাথে হয়েছে আমাদের। সেভেনে পড়তেই আমি তাকে আর্কিমিডিস, নিউটন ইত্যাদি পড়াতাম, সে গভীর আকর্ষণে শিখতে থাকতো। ছাদে পাটি পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়তাম। শিখতে সে কী আনন্দ পায়, এটা তাকে কাছ থেকে না দেখলে বুঝা যাবে না। আমার শেষ ছুটিতেও আমি তাকে মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স পড়িয়ে আসছি। সে সিভিলের ছাত্র হয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা কোর্স পড়ে ফেলছে খুব আনন্দের সাথে। কেন পড়ছে জানে না, কিন্তু তার ভালো লাগছে পড়তে।

গণিতে তার মেধা ছিলো ঈর্ষণীয়। তার ইচ্ছা ছিল গণিতে সুইচ করার। ওকে পড়ানোর সময় ক্যালকুলেটর প্রয়োজন হতো না আমার। পারিবারিক সংস্কৃতির কারণেই হয়ত, পরশ ছিল অত্যান্ত নম্র একজন মানুষ। পরশকে তার ছোটো ভাইদের সাথে দু'একবার চিৎকার করতে দেখেছি সেই ছোটো বয়সে। এছাড়া কখনো কোনো উচ্চবাচ্যের রেকর্ড তার নাই। রিকশাওয়ালদের ভাড়া দেওয়া শেষে সে সবসময় বলতো, ‘ধন্যবাদ’। এই প্র‍্যাক্টিসটা আমি ওর কাছ থেকে শেষ একবছর ধরে শেখার চেষ্টা করেছি।

পরশ ছিলো নিরহংকারী। ওর মতো একজনের সামান্য হলেও অহংকার থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তার কোনো অহংকার ছিল না। আপনি নো-বডি হলেও আপনি যদি তাকে এক বর্ণ শেখানোর সক্ষমতা রাখেন, পরশকে আপনি শিষ্য হিসাবে পাবেন। মনোযোগী শ্রোতা ছিলো সে, কিন্তু বলবে সামান্য।

পরশ খুবই ফ্লুয়েন্ট স্পিকার ছিল না আমি যতদূর দেখেছি। কথা জড়িয়ে যেত। কিন্তু যখনই তার মনে হয়েছে পরিষ্কার করে কথা বলতে শেখা দরকার, তখনই সে আবৃত্তি ক্লাস করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সুন্দর করে কথা বলতে শিখে, জড়তা কাটিয়ে উঠে। তারপর সে ডিবেট করে। জাতীয় টেলিভিশনে বিতর্ক করে। কিছুদিনের মধ্যেই বিতর্কে তার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল বিশ্বমঞ্চে, মাদ্রিদে।

আওর পড়ুন: ধূমপানই করেনি, ছেলের মাদক সংশ্লিষ্টতার প্রশ্ন আসে না: বুয়েটে ফারদিনের বাবা

পরশের স্বপ্ন, রুচি, চিন্তা, কথা বলা, বডি ল্যাংগুয়েজ, ব্যবহার ছিল উন্নতমানের। মাঝারি মানের কিছুই তার পছন্দ ছিল না। সেটা খাবার হোক, বা তার কোনো অর্জন। আমি এলাকায় আসলে আমি চাইতাম না এলাকার বাহিরে যেতে। সে আমারে প্রায় জোর করে ধানমন্ডি নিয়ে যেত, সেখানকার খাবার তার বেশি পছন্দ। বলত, ‘পাস্তা বা বার্গারই যখন খাবেন, এলাকার শিট কেন খাবেন। ধানমন্ডির ওমুর রেস্টুরেন্টে এইটা ভালো’। অর্থাৎ তার সেরাটা চাই।

অসাধারণ কিছু করবার ইচ্ছা তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাড়িয়ে বেড়াত। ভার্সিটিতে তার রেজাল্ট কিছুটা ড্রপ করায় চিন্তা করতো, কিভাবে ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কের সেরা ভার্সিটিতে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পাওয়া যায়। আমার মিডিওকার চিন্তা ছিল ওর অপছন্দ।

ছোটোবেলা থেকে সে নানান সোশাল ওয়ার্কের সাথে যুক্ত ছিল। আমাকে একবার সে বলছে যে, ‘ক্রোধগুলো জমায়ে রাখেন, সময়মত কাজে লাগবে।’ নানান জায়গার নানান অসমতা, অনিয়ম, অবিচার আমাদের কষ্ট দিত, ভাবাতো। তাই সে ক্রোধ জমিয়ে রাখতে বলে, সময়মতো যেন আমরা অসমতা, অনিয়ম, অবিচারের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারি। পরশের ফেসবুকের বায়োতে লেখা, ‘ভালবাসি বই, গণিত, শিশু ও হাসি। পছন্দ পরিশ্রমী, স্বপ্নবাজ ও চিন্তাশীল মানুষদের। বিশ্বাস মেধা ও মননে।’

পরশ সমসাময়িক নানান বিষয়ে জ্ঞান রাখতো, কিন্তু একটিভিজম করতো না। সে কভার ফটো দিয়ে আমাকে দেখায়, বলে, বাইরে যাওয়ার আগে আর এইটা চেঞ্জ করবো না। কভারফটোটায় হাত চোখ, কান ও মুখ বন্ধ করে রাখা কার্টুন ছিল। ক্যাপশন ছিল, ‘How to survive in this country 101’। একই কভারফটো ও ক্যাপশন আমারও দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমি যেহেতু কম বেশি লিখে ফেলি, তাই সেটা আমি করতে পারিনি।

সুতরাং, তার এমন কোনো একটিভিটি ছিলো না যেটা কন্ট্রোভার্সি ক্রিয়েট করবে। সে শুধু পার্সোনাল ব্লগিং করত, নিজের ইম্প্রুভমেন্টের জন্য। কিন্তু সে কনশাস ছিল।

পরশের কোনো নারীঘটিত কোনো ঝামেলা কারোর সাথে থাকার কথা না। সে বই পড়ে, ডিবেট করে, সোশাল ওয়ার্ক করে, এবং তার মতো মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করে। সে সবসময়ই আমাকে বলতো যে, ‘আমি ফানি হতে পারি না। মানুষ আমার সঙ্গ উপভোগ করে না। কারণ আমি আড্ডায় মিশতে পারি না। অন্যদের মুখরোচক গল্প-কাহিনী শুনতে পছন্দ করি না। ডার্ক হিউমার পছন্দ করি না। আমার কোনো বন্ধু হয় না।’ 

পরশ নারীবিদ্বেষী মন্তব্য বা কৌতুক খুবই অপছন্দ করতো। তাই সেইসব আড্ডা সে এড়িয়ে চলতো। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, সে কখনোই কাউকে কোনো কাজে জাজ করতো না। শুধু বলতো, ‘এটা আমার পছন্দ না। তার মানে এটা না যে আমি তাকে ভুল বলছি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের নানান কাজে নানান মানুষের সাথে মিশতে হয়, বন্ধুত্ব হয়। বন্ধু নির্বাচনে এত সতর্ক একজন মানুষের ব্যাপারে না জেনে বাজে মন্তব্য করা খুবই অভদ্রোচিত। পরশ ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ ছিল। এমন একজন মানুষকে নিয়ে আবার কিছু নিউজ করছে ফান্ডামেন্টালিস্ট সন্দেহ করে। আর যেহেতু সে কোনো একটিভিজম করতো না, তাই তার উল্টোটাও সত্যি হওয়ার চান্স কম।

সহজ কথায়, ওর কোনো শত্রু তৈরি হওয়ার কোনো ক্লু নাই। তার পরিবারে একটা টিপিক্যাল টানাপোড়েনের পরিবার। কিন্তু অত্যান্ত ভদ্র ও শিক্ষিত পরিবার, যেই পরিবারে ঘরে খাবার না থাকলেও বইয়ের অভাব হয় না। কখনও কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার করার রেকর্ড তার পরিবারের কারোর নাই। পারিবারিক শত্রুতা নাই। পরশের কোনো একটিভিজম নাই, তার কাজ ছিলো শুধু ডিবেট, টিউশনি, পড়াশুনা, ল্যাপটপের দুএকটি গেম, ও খাওয়াদাওয়া। নারী-সংশ্লিষ্ট কিছুও নাই আমার জানা মতে।

তার মত একটা অসাধারণ মেধাবী, কিন্তু সাধারণ ছেলেকে কারা এভাবে হত্যা করলো, এই ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণাই থাকা সম্ভব না। আমি এখনও এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।

পরশ আমাকে নিয়মিত ভালো কিছুর জন্য পুশ করতো। অক্টোবরের একত্রিশ তারিখে আমার থিসিস ডিফেন্স নিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছিলো, আর তার সার্ভে নিয়ে প্যারার কথা বলছিলো। এই মাসের তিন তারিখে আমি তাকে মেসেজ দিয়ে বলছিলাম যেন ঢাকায় টিউশন থাকলে আমার জন্য রাখে, আমি ডিফেন্সের পরই আসছি ঢাকায়। পরশ মেন্টালি, ফিজিক্যালি পার্ফেক্ট ছিল মৃতুর আগ পর্যন্ত। এমন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে কেন মার্ডার করা হলো?

আমি ডিফেন্সের পর ঢাকায় গেলে তাকে স্টেক খাওয়ানোর কথা। আমি টাকা কই পাবো সেটা নিয়ে ছিলাম দুশ্চিন্তায়। কিন্তু সে আমাকে এই দুশ্চিন্তা করার সুযোগটাও আর রাখলো না।

আমার মেসেঞ্জারে পরশের নিকনেম ‘পুরান পাপী’। পুরান পাপী আমাকে যখন তখন আর মেসেজ দিবে না, এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আজকে আমার ডিফেন্স যে বিভৎস হয়েছে, এই হাহাকার আমি কার কাছে করবো? তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আমি দুস্বপ্নে দেখছি কোনো। নিশ্চয়ই ঢাকায় গেলেই পরশের ফোনকল আসবে আমার মোবাইলে। আমি ধরবো। পরশ বলবে, ‘ছোটন ভাইয়া, আজকে সলিড কিছু খাওয়া লাগবে।’’


সর্বশেষ সংবাদ