প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ২৪ বছরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়   © টিডিসি ফটো

বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠার ২৩ বছর শেষ করে ২৪তম বছরে পদার্পণ করলো কৃষি ও বিজ্ঞান চর্চার উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি)। ১৯৯৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির লক্ষ্য নিয়ে নানাবিধ সংকট থাকা স্বত্ত্বেও এগিয়ে চলছে সামনের দিকে৷দীর্ঘ এ পথচলায় প্রাপ্তির খাতায় যেমন যুক্ত হয়েছে নানা অর্জন, তেমনি অপ্রাপ্তিও আছে অনেক। 

দিনাজপুর সদর হতে ১০ কিলোমিটার দূরে বাঁশেরহাট নামক স্থানে ৮৫ একর জায়গা জুড়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) ক্যাম্পাসটি অবস্থিত। তেঁভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের নামে নামকরন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরুর পূর্বে এটি ১৯৭৬ সালে এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট (AETI) হিসেবে কৃষিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদান করতো। পরে ১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর ইনস্টিউটকে স্নাতক পর্যায়ে কৃষি কলেজে উন্নীত করা হয়। এটি তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর অধিভুক্ত কলেজ ছিল।

Untitled-1 c41opy

পরে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার লক্ষে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। ৮ জুলাই ২০০১ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হয় এবং ২০০২ সালের ৮ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ায় মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট মৃত্তিকা বিজ্ঞানী প্রফেসর ড: মো: মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। বর্তমানে ৭ম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড.এম.কামরুজ্জামান।

সবুজ গাছপালার সমারোহে বেষ্টিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে লাল-সাদা ইটের দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল ভবন, আছে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার, জিমন্যাশিয়াম, টিএসসি, ক্যান্টিন। অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ৫টি অ্যাকাডেমিক ভবন (১ টি নিমার্ণাধীন), একটি প্রশাসনিক ভবন, ৫টি ছাত্র হোস্টেল (একটি বিদেশী শিক্ষার্থীদের), ৪ টি ছাত্রী হোস্টেল (নির্মাণাধীন ১ টি সহ) আধুনিক সাজসজ্জা বিশিষ্ট ১০০ আসনের একটি ভিআইপি সেমিনার কক্ষ, ৬০০ ও ২৫০ আসন বিশিষ্ট দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অডিটরিয়াম।

এছাড়াও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ করতে রয়েছে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্লাব, ২টি মসজিদ, ১৩৬টি আবাসিক ইউনিট/ভবন, ১টি শিশুপার্ক, পোষ্ট অফিস, রূপালী ব্যাংক শাখা, মেঘনা ব্যাংক শাখা, শ্রমিক ব্যারাক, নিজস্ব বৈদ্যুতিক লাইন, বৃহৎ খেলার মাঠ, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।

গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সমন্বয় ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (আই.আর.টি.)। আছে একটি ভি. আই. পি গেস্ট হাউস, হাবিপ্রবি স্কুল, ডাক্তার ও এ্যাম্বুলেন্সসহ ১২ শয্যার একটি মেডিক্যাল সেন্টারও।গবেষণালব্ধ থিসিস, রিপোর্ট, জার্নালের পাশাপাশি রয়েছে ৩৫ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালির আকর্ষণীয় সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং বিভিন্ন বিভাগের তত্ত্বাবধানে গবেষণার জন্য জামপর্স্নাজম সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হিসেবে সরকারি শহীদ আকবর আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ রয়েছে। কৃষকের দোর গোড়ায় কৃষিসেবা পৌঁছে দিতে নির্মিত হয়েছে কৃষক সেবা কেন্দ্র, গবাদিপশুর চিকিৎসা সেবায় রয়েছে ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতাল ও মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক, স্কলারশিপ ও ক্যারিয়ার সংক্রান্ত তথ্যের জন্য আছে ক্যারিয়ার এডভাইজারি সার্ভিস (ক্যাডস) এবং একটি কৃষি,মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা কমপ্লেক্স।

Untitled-1 74

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি কোর্স ক্রেডিট সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত। বর্তমানে ৯টি অনুষদের অধীনে (পোস্টগ্র্যাজুয়েটসহ) ৪৫টি বিষয়ের ওপর ২৩টি ডিগ্রি প্রদান করা হয় এবং প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ৩২১ জন। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক শিক্ষক উচ্চতর ডিগ্রির জন্য দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তবে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২০ হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে এখন রয়েছে ১:৩৭। অপরদিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে একই সাথে একই ক্লাসে একজন শিক্ষককে শতাধিক শিক্ষার্থীর ক্লাস নিতে হচ্ছে। ফলে যারা পিছনের সারিতে বসেন তাঁদের অনেকেই ক্লাসে মনোযোগী হতে পারেন না। যা গুণগত শিক্ষার মানোন্নয়নে অন্তরায়। এছাড়া চার মাসে সেমিস্টার কার্যকর হওয়ায় শিক্ষর্থীদের ক্লাসের সংখ্যা কমেছে প্রায় অর্ধেকের কোটায়। 

নানা প্রাপ্তির মাঝেও হিসাবের খাতায় ছোট নয় অপ্রাপ্তির তালিকাও। দীর্ঘ এ পথচলায় নানামুখী সংকট ছিল প্রতিষ্ঠানটির নিত্য সঙ্গী। তাই ২৩ বছরেও নানাবিধ সংকটের কাঠগড়া থেকে বের হতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিভাগ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। নিশ্চিত হয়নি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থাও। পর্যাপ্ত নয় পরিবহন সংখ্যাও। ছাত্র সংসদের ফি নেয়া হলেও দুই দশকেও নির্বাচন হয়নি ছাত্র সংসদ, এমনকি নেই কোন ছাত্র সংসদ ভবন। শিক্ষার্থীরা দাবি করে আসলেও এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপও নেয়নি কর্তৃপক্ষ। প্রায় এক দশক থেকে নেই শিক্ষক সমিতিরও কোন কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে রেজিস্টার্ড গ্র‍্যাজুয়েট এর কথা উল্লেখ থাকলেও এখন পর্যন্ত সে স্বীকৃতি পায়নি বিগত সময়ে পাশ করে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। বিগত ২৩ বছরেও উপ-উপাচার্য নিয়োগ হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। হয়নি কোন এলামনাই এসোসিয়েশনও। ২৩ বছরে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র একবার সেটিও ১ যুগ পূর্বে। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন হলের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অন্যতম অংশ গবেষণা। সেই গবেষণা কাজের জন্য নেই পর্যাপ্ত গবেষণা মাঠ কিংবা আন্তজার্তিক মানের গবেষণাগার। যেগুলো আছে সেগুলোতে আছে নানাবিধ সমস্যা। প্রায় দুই যুগ হতে চলা অধিক বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমান বিভাগ সংখ্যা ৪৫টি। নতুন বিভাগ খোলাতে রয়েছে নানা সংকট। নতুন অনেকে বিভাগেরই নেই নিজস্ব শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব ও সেমিনার কক্ষ। ফলে ক্লাস করতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষার্থীদের।

প্রায় দুই যুগের এই দীর্ঘ পথচলায় হাবিপ্রবির শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় ছয়টি ফসলের জাত উদ্ভাবন করার পাশাপাশি হাবিপ্রবির ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় শস্য দ্রুত শুকানোর যন্ত্র এবং কালো জামের জুস বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এছাড়া আরো সম্ভাবনাময় নানামুখী গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির দক্ষ ও মেধাবী গবেষকবৃন্দ।

বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্রী সাদিয়া জাহান মিম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে গণমাধ্যমে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে জানান,‘ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য গবেষণা। শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়ানো, গবেষণার মাধ্যমে একটা প্রতিষ্ঠান উন্নতির উচ্চ শিখরে যেতে পারে। তবে একই সাথে অবকাঠামো ও শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ও গুরুত্বপূর্ণ। যেসব বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে, নতুন শিক্ষক নিয়াগের ব্যবস্থা করা। আবাসন সমস্যা তো অনেক দিনের।আবাসিক হলে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীকে বাইরে অবস্থান করতে হয়। দীর্ঘদিন থেকে শুনছি নবনির্মিত ছাত্রী হল খুলে দেয়া হবে। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না কিছুতেই। অন্যদিকে করোনার পূর্বের বাসের সিডিউল আর আর বর্তমান সময়ের বাসের সিডিউলের মাঝে বিস্তার পার্থক্য। এতে করে শিক্ষার্থীদের তীব্র পরিবহন সংকটে পরতে হচ্ছে।  লাইব্রেরিতে অনেক বই পাওয়া যায় না, লাইব্রেরির সিট সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় শিক্ষার্থীদের তুলনায়, এই জন্য লাইব্রেরির সিট সংখ্যা এবং বই সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে এই বিষয়গুলো প্রত্যাশা করছি।’

Untitled-1 74

মহিউদ্দিন নামের আরেক শিক্ষার্থী  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘শেষ বর্ষে এসে প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি আর প্রত্যাশার হিসেবটা একটু বড়ই! প্রথমই বলতে হয় প্রাপ্তির কথা, ২০১৭ সালে পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিলো তখন নিজের আইডেন্টিটি তৈরী করে দিয়েছিলো সবুজেঘেরা এই হাবিপ্রবি। নিজেকে তুলে ধরার অনেক প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি, পেয়েছি ব্রড মাইন্ডেড টিচার, মেন্টর আর বন্ধুবান্ধব। অপ্রাপ্তির প্রথম কাতারে রাখতে চাই সময়মত গ্রেজুয়েশন কম্পলিট করতে না পারাটা। দ্রুত অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, সুন্দর রাজনৈতিক চর্চা, দ্রুত কনভোকেশন,  টিএসটির সম্প্রসারণ, বাসের ট্রিপ বৃদ্ধি,  শিক্ষক সংকট সহ নানাবিধ সমস্যা সমাধানের সময় এসে গেছে।’

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেন নি।

প্রসঙ্গত , বৃটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে  রাষ্ট্রীয় শোক পালন করায় (৯ -১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচি সমূহ একদিন পিছানো হয়েছে ( ১২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে) । তবে উক্ত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের  ক্লাস-পরীক্ষা যথারীতি চলবে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence