নবম-দশমের শারীরিক শিক্ষা
আট বছর ধরে ভুল পড়ছেন মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা
- শিহাব উদ্দিন
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৯ PM , আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৩৭ PM
আট বছর ধরে মাধ্যমিকের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ে ভুল পড়ছেন। নবম-দশম শ্রেণিতে ২০১৮ সালে যে নতুন বই ‘শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা’ যুক্ত করা হয় তাতে চলতি বছরও এই ভুল রয়ে গেছে। বইটিতে শুরু থেকেই গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর একটি উক্তিকে সক্রেটিসের উক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৫ সালে যারা এই বই পড়ছেন, তারাও ভুল শিখেছেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) , নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এবং বই ঘেটে দেখা গেছে, বইটির চতুর্থ অধ্যায় ‘স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসেবা’তে লেখা আছে- “সক্রেটিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্লেটোস রিপাবলিক’ এর চতুর্থ অধ্যায়ে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন- ‘Now to produce health is to part the various parts of the body in their natural relations of authority or subservience to one another, whilst to produce disease is to disturb their natural relation’. কিন্তু বাস্তবে হুবহু ‘প্লেটোস রিপাবলিক’ নামে কোনো বইয়ের অস্তিত্ব নেই। শুধু তাই নয়, মাধ্যমিকেও ওই অধ্যায়ে এমনভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে; যাতে মনে হচ্ছে সক্রেটিস প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের ওপর কোনো বিশ্লেষণমূলক বই লিখেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্লেটো সক্রেটিসের ছাত্র।
বাস্তবে সক্রেটিস নিজে কোনো বই লেখেননি; বরং শিষ্য প্লেটো এবং জেনোফোন তাদের লেখায় সক্রেটিস ও তার দর্শন তুলে ধরেছেন; এর মধ্যে প্লেটোর দ্য রিপাবলিক (The Republic) অন্যতম। বিখ্যাত বইগুলোতে সক্রেটিসকে কথোপকথনের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
তাছাড়া বাস্তবে সক্রেটিস নিজে কোনো বই লেখেননি; বরং শিষ্য প্লেটো এবং জেনোফোন তাদের লেখায় সক্রেটিস ও তার দর্শন তুলে ধরেছেন; এর মধ্যে প্লেটোর দ্য রিপাবলিক (The Republic) অন্যতম। এর বাইরে প্লেটোর লেখা 'এপোলজি' (Apology), 'ক্রিটো' (Crito), এবং 'ইউথিফ্রন' (Euthyphron) বিখ্যাত, যেখানে সক্রেটিসকে কথোপকথনের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে দর্শন লিখিত রূপের চেয়ে সংলাপ ও সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে বেশি ভালোভাবে শেখানো যায়, তাই তিনি নিজে কিছু লিখে যাননি, বরং সরাসরি প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ করতেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি বলে নবম-দশম শ্রেণির ‘শারীরিক শিক্ষা’ বইটিতে যে উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, বাস্তবে তা বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর উক্তি। এটি প্লেটোর ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থ থেকেই উদ্ধৃত করা হয়েছ। উক্তিটি তিনি দেহের স্বাস্থ্যের সঙ্গে আত্মার স্বাস্থ্যের সম্পর্ক এবং নগরকার্য পরিচালনার স্থিরতার বিষয়ে উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
‘এটা সম্পূর্ণ ভুল। সক্রেটিস কখনো কোনও বই লেখেননি। ‘দ্য রিপাবলিক’ নামে একটি বিখ্যাত বই আছে, তা প্লেটো লিখেছেন।’ -অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ ভুল। সক্রেটিস কখনো কোনো বই লেখেননি। ‘দ্য রিপাবলিক’ নামে একটি বিখ্যাত বই আছে, তা প্লেটো লিখেছেন।’
এদিকে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা জানান, “সম্প্রতি ভুলটি সনাক্ত করা হয়েছে এবং ২০২৬ সালের বইয়ের জন্য পরিমার্জিত বইয়ে ইতিমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে। এছাড়া আগে উক্তিটি বইয়ে ইংরেজি ভাষায় লিখিত থাকলেও এবার সেটি বাংলায় লেখা হয়েছে।”
ভুলের বিষয়ে জানেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
নবম-দশম শ্রেণির ‘শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা’ বইটির ভুল তথ্যের ব্যাপারে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলেছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। তবে তারা এ ধরনের ভুলের বিষয়টি জানেনই না।
আরও পড়ুন: স্কুলে ভর্তির লটারি কাল, ফল দেখা যাবে ঘরে বসেই
তারা বলছেন, ‘স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা’ বিষয়ে ঠিকমতো পাঠদানই হয় না। অনেকক্ষেত্রে নিয়মিত পরীক্ষাও হয় না। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জিপিএ ফাইভ পান। ব্যবহারিক পরীক্ষার মতোই এই বিষয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার দিন স্কুলে টাকা দিতে হয়। তাই সবাইকে জিপিএ ফাইভ দেওয়া হয়। অন্যরাও জিপিএ ফোরের ওপরেই পান।
‘প্রতিটি বিষয়ের ভুল-ত্রুটি যাচাইয়ের জন্য প্রতিবছর ৫-৬ জনের একটি করে প্যানেল করা হয়। সেই প্যানেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন স্কুল থেকে সংশ্লিষ্ট সাবজেক্টের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তারা থাকেন। এরপরও টানা আট বছর কীভাবে বিষয়টি সবার চোখ এড়িয়ে গেলো তা বোধগম্য নয়। আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।-এনসিটিবি কর্মকর্তা
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া আকবর আলী কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. হৃদয় সরকার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে ঠিকমতো ক্লাস হয়নি স্কুলে। এসএসসি বোর্ড পরীক্ষার পর ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় স্কুলের স্যাররা ৫০ নম্বরের একটি পরীক্ষা নিয়েছেন। তারাই বোর্ডে নাম্বার পাঠিয়ে দিয়েছেন।’ এই পরীক্ষার জন্য কতো টাকা দিতে হয়েছে জানতে চাইলে তাহসিন বলেন, ‘শিক্ষার্থীপ্রতি ১০০ টাকা।’
বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সজীব বলেন, ‘নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে আমরা উক্তিটি সক্রেটিসের বলেই পড়েছি। একজন শিক্ষক এই সাবজেক্টের দ্বায়িত্বে ছিলেন। তিনি সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে বইটি পড়াননি।’
সিরাজগঞ্জ, বগুড়া এবং গাইবান্ধার তিনটি স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এই প্রতিবেদকের কাছেই বিষয়টি প্রথম শুনলেন। প্লেটোর উক্তি সক্রেটিসের বলে চালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় এই তিন শিক্ষকের কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মাধ্যমিক শাখার ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ মো. মোস্তফা সাইফুল আলম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রতিটি বিষয়ের ভুল-ত্রুটি যাচাইয়ের জন্য প্রতিবছর ৫-৬ জনের একটি করে প্যানেল করা হয়। সেই প্যানেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন স্কুল থেকে সংশ্লিষ্ট সাবজেক্টের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তারা থাকেন। এরপরও টানা আট বছর কীভাবে বিষয়টি সবার চোখ এড়িয়ে গেলো তা বোধগম্য নয়। আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলব। যদি ভুল থেকে থাকে তাহলে তা অবশ্যই সংশোধন করা হবে।’