নারী গ্রাহকের ফোনে অশালীন মেসেজ ফুডপান্ডা রাইডারের, অনলাইন কেনাকাটায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা
- তৌহিদুর রহমান তুহি
- প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:২৬ PM , আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৯ PM
সম্প্রতি অনলাইন খাবার ডেলিভারি অ্যাপ ফুডপান্ডার মাধ্যমে খাবার অর্ডার করেন ধানমন্ডির এক বাসিন্দা। খাবার পৌঁছাতে এসে নম্বরে ফোন করার পরিবর্তে হোয়াটসঅ্যাপে কল করেন রাইডার শিফাতুল ইসলাম শিহাব। খাবার ডেলিভারির পরদিন অর্ডার করা ওই নারীর অশালীন মেসেজ পাঠান শিহাব। এই ঘটনার পর অনলাইনে কেনাকাটায় গ্রাহকের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
ভুক্তভোগী নারী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, রোববার (১২ অক্টোবর) রাতে আমি ফুডপান্ডা থেকে খাবার অর্ডার করি। রাইডার খাবার পৌঁছানোর সময় আমার নম্বরে কল না করে হোয়াটসঅ্যাপে কল দেয়। পরে ডেলিভারি দিয়ে চলে যায়। পরবর্তীতে সে আমার হোয়াটসঅ্যাপে অশালীন বার্তা পাঠায়।
বিষয়টি নিয়ে ফুডপান্ডায় অভিযোগ করলে তারা বিষয়টি নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে এবং রাইডারকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানায়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ফুডপান্ডার রাইডার খাবার পৌঁছানোর পর আমাকে এই ধরণের মেসেজ করছে। তারা রাইডারদের কী ধরণের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে? এ ধরণের কার্যকলাপ না করতে ফুডপান্ডা কি দিকনির্দেশনা দেয় না?
রাইডার শিহাব বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ওইদিন রাতে ডেলিভারি দিয়ে আসার পর মাহিন নামে আমার এক বন্ধু নতুন মোবাইল কিনে আনে। পরে সে আমার হোয়াটসঅ্যাপ নিজের মোবাইলে লগইন করে এবং সেই ওই নম্বরে ছবিগুলো পাঠায়।
শিহাবের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায়। একমাস আগে ঢাকায় এসে তিনি ফুডপান্ডায় রাইডার হিসেবে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তার ফুডপান্ডার আইডি সাসপেন্ড করা রয়েছে বলে জানান এই রাইডার। চাকরি শুরুর আগে তাকে হয়রানি না করতে সচেতনতামূলক বার্তা বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্ন করা হলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ওই রাইডার।
আরও পড়ুন: নারী সাংবাদিকের আত্মহত্যা নিয়ে তোলপাড়, নেপথ্যে সহকর্মীর ‘যৌন হয়রানি’
ফুডপান্ডা অবশ্য বলছে, রাইডাররা ফ্রিল্যান্স হিসেবে কাজ করেন। তাদের সঙ্গে কোম্পানির তেমন কোনো চুক্তি থাকে না। যার কারণে অভিযুক্ত রাইডারকে চাকরিচ্যুত করার সুযোগ নেই, তবে তাকে ফুডপান্ডা থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সে আর ফুডপান্ডার হয়ে কাজ করতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে বলেছে, ফুডপান্ডা রাইডার নেয়ার পরে কাজ শুরুর আগে তাদেরকে অল্প সময়ের একটি সেশনের মাধ্যমে ভালো ব্যবহার করতে প্রশিক্ষণ দেয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই আলাদা করে নারী গ্রাহকদের হয়রানি না করতে বা ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে সহজেই রাইডাররা এ ধরনের কাজে নিজেদের যুক্ত করছে।
অনলাইনে কেনাকাটায় নিরাপত্তার জন্য গ্রাহক ও বিক্রেতা উভয়ের সতর্কতা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখানে দুইটা দিক একটা হচ্ছে ব্যবহারকারীর অন্যটা বিক্রেতার। ক্রেতার দেখতে হবে আমি তথ্যটা কোথায় দিচ্ছি, সেখানে আমি কতটা নিরাপদ, যে কোম্পানিতে আমি লেনদেন করছি, সে আমার তথ্যের ব্যাপারে কতটা আন্তরিক? সার্বিকভাবে সুরক্ষার ব্যাপার বিবেচনা রাখতে হবে। যেখানে সেখানে তথ্য দেয়া যাবে না।
অপরদিকে যেসব কোম্পানি আমাদের ডিজিটাল সেবা দিচ্ছে, তাদের গ্রাহকের তথ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন থাকা দরকার। পাশাপাশি তাদের কর্মীদের এই ব্যাপারে নিয়মিত মনিটরের মধ্যে রাখতে হবে এবং প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে। কর্মীদের মোটিভেশনের মধ্যে রাখতে হবে এবং বুঝাতে হবে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক কর্মীকে সচেতন হওয়া জরুরি।
তবে সতর্ক থাকার পরও এমন ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের উচিত হবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাছে রিপোর্ট করা। আর কোম্পানিকেও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে অন্যরা সতর্ক হয়। পাশাপাশি ভুক্তভোগী চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তখন অপরাধের ধরন অনুযায়ী, আইনে যে শাস্তি আছে সেটা আদালত নির্ধারণ করবেন।
প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের পর যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব অপরাধের না করতে সতর্ক করা এবং অপরাধের শাস্তির বিধান সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারনা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এডভোকেসি এন্ড লবীর পরিচালক এ্যাড. দীপ্তি সিকদার।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে এ্যাড. দীপ্তি বলেন, অনলাইনে ব্যবসা এখন অনেকেই করছে এবং বিভিন্ন রাইড শেয়ারের মাধ্যমে তারা পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকরা অনলাইন অফলাইন দুইভাবেই কিন্তু প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, দুটিই অপরাধ।
আমাদের দেশে যে প্রচলিত আইনে ফোনে বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাউকে বাজে মন্তব্য করা কিংবা অশালীন ছবি, ভিডিও কিংবা মেসেজ পাঠানো অপরাধ। এক্ষেত্রে অনলাইন ব্যবসাগুলো একটা নীতিমালার মাঝখানে আসা উচিত। যেখানে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত যে সহিংসতার ঘটনা ঘটলে ওই কোম্পানিতে অভিযোগ করার সহজ সুবিধা থাকতে হবে। প্রতিকারের জন্য কোথায় যাবে কি করবে না করবে সেটারও একটা স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। এই বিষয়গুলা এবং প্রতিরোধে একটা কমিটি থাকাও দরকার।
এমন ঘটনা ঘটলে কোথায় অভিযোগ করবে, কি করবে এবং সেটা কোম্পানির ওয়েবসাইটে সহজভাবে উল্লেখ করতে হবে। পাশাপাশি অভিযোগ পেলে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে অন্য কেউ এমন হয়রানির শিকার হলে, সেও আস্থা রেখে অভিযোগ করতে পারেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় থাকা জরুরি নম্বরগুলো বেশি বেশি প্রচার করা প্রয়োজন। এছাড়া এ ধরনের অপরাধের শাস্তির বিষয়গুলোও বেশি বেশি প্রচার করতে হবে, যাতে করে কেউ অপরাধ করার আগে অবশ্যই শাস্তির বিষয়টি চিন্তা করে এসব কাজ থেকে বিরত থাকে।
প্রসঙ্গত, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ এর ২৫ এর ১ ও ২ ধারায় যৌন হয়রানি ব্লাকমেইলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তি হিসেবে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, কিংবা উভয় দণ্ড পেতে পারেন। আর কোনো নারী বা অনূর্ধ্ব ১৮ (আঠারে বৎসরের কোনো শিশুর বিরুদ্ধে সংঘটন করেন, তবে অভিযুক্তকে অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।