ধান চাষে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: কী বলছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর?
- আশরাফ আন নূর
- প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ১০:১৭ PM , আপডেট: ২৩ মে ২০২৫, ১১:২৫ AM
দেশের কৃষি খাতে ধান চাষে প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ আবাদযোগ্য জমিতে ধান চাষ হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে সময়, শ্রম ও খরচ কমিয়ে কৃষকদের কাজকে আরও সহজ করে তুলেছে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ধান চাষে এসেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
আজ বৃহস্পতিবার ( ২২ মে) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিবেদককে এসব তথ্য জানান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’-এর সিনিয়র মনিটরিং অফিসার মো. ইখলাস আশরাফ দেশে ব্যবহৃত কিছু ধান চাষে যন্ত্রপাতির কথা তুলে ধরে বলেন, এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটছে।
আরও পড়ুন: প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নাহিদের বৈঠক, গুঞ্জন
রাইস ট্রান্সপ্লান্টার
রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ধানের চারা রোপণের জন্য ব্যবহৃত একটি আধুনিক কৃষিযন্ত্র। এটি মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে—ওয়াকিং টাইপ (হেঁটে চালানোর যন্ত্র) এবং রাইডিং টাইপ (বসে চালানোর যন্ত্র)। উভয় প্রকার যন্ত্রই কৃষিকাজে সময়, শ্রম ও খরচ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ওয়াকিং টাইপ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার সাধারণত পেট্রলে চালিত হয়। এটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ লিটার তেল খরচ করে এবং একটানা ৪টি লাইনে ধানের চারা রোপণ করতে সক্ষম। এই যন্ত্রটি ঘণ্টায় ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ধানের চারা রোপণ করতে পারে। বাজারে এর মূল্য সাধারণত ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
অন্যদিকে, রাইডিং টাইপ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ডিজেলে চালিত হয় এবং এটি প্রতি ঘণ্টায় ৪ লিটার ডিজেল ব্যবহার করে। এটি একটানা ৬টি লাইনে ধানের চারা রোপণ করতে পারে এবং ঘণ্টায় শতভাগ রোপণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সক্ষম। এর বাজার মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি যা ১০ থেকে ১৬ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার প্রযুক্তির ব্যবহারে ধানের চারা রোপণ অনেক সহজ হয়েছে। আগে কৃষকদের হাতে চারা রোপণ করতে হতো যা সময়সাপেক্ষ এবং শ্রমনির্ভর ছিল। এতে একদিকে যেমন অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হতো, অন্যদিকে কৃষকদের কষ্টও হতো বেশি। কিন্তু এই প্রযুক্তির মাধ্যমে চারা রোপণে সময় ও কষ্ট—দুইই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। ফলে কৃষিকাজ এখন আরও সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক হয়েছে।
কম্বাইন হারভেস্টার
কম্বাইন হারভেস্টার (ধান কাটার যন্ত্র)। এটা সাধারণত দুই ধরনের ফুলফিট( খড় আলাদাভাবে পরে যায়) ও হাফফিট (খড় আলাদাভাবে পরে না) কম্বাইন হারভেস্টারের মূল্য সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ লক্ষ্য টাকা।
কম্বাইন হারভেস্টার একটি আধুনিক ধান কাটার যন্ত্র যা ধান কাটা, মাড়াই এবং ঝাড়াই—এই তিনটি কাজ একসঙ্গে করতে পারে। এতে কৃষিকাজে সময় ও শ্রম অনেক কম লাগে, উৎপাদনশীলতাও বাড়ে। এই যন্ত্র সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে—ফুলফিট এবং হাফফিট কম্বাইন্ড হারভেস্টার।
ফুলফিট কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহারে ধান কাটার পর খড় আলাদাভাবে পড়ে যায় যা পরবর্তী সময়ে পশুখাদ্য, জৈবসার অথবা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি মূলত অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি ও শুষ্ক এলাকার জন্য উপযোগী।
আরও পড়ুন: প্রধান উপদেষ্টাকে র্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জামায়াতের
অন্যদিকে হাফফিট কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে ধান ও খড় একসঙ্গে পড়ে, খড় আলাদা করা যায় না। এটি সাধারণত নীচু বা আর্দ্র জমিতে বেশি কার্যকর। এই আধুনিক যন্ত্রের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। বাজারে কম্বাইন হারভেস্টার মূল্য সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে মডেল, ব্র্যান্ড ও প্রযুক্তিগত সুবিধাভেদে দামের কিছুটা তারতম্য দেখা যায়।
রিপার
ধান কাটার আধুনিক যন্ত্রের মধ্যে রিপার একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এই যন্ত্রের মাধ্যমে শুধু ধান কাটা সম্ভব হয়। এটি হাতে ধান কাটার তুলনায় অনেক দ্রুত এবং সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করে। সাধারণত রিপার যন্ত্রের মূল্য ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে যা মাঝারি কৃষক পর্যায়ের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য।
উইনোয়ার
ধান কাটার পর ধান পরিষ্কার ও প্রস্তুতির জন্য ব্যবহৃত হয় উইনোয়ার। এই যন্ত্রটি ধান থেকে ধূলাবালি, খড়কুটা ও অন্যান্য আবর্জনা সরিয়ে ফেলে এবং চিটা থাকলে তা আলাদা করে দেয়। ফলে ধান বাজারজাত বা সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত হয়।
ড্রায়ার
ধান কাটার পর তা দ্রুত ও সমভাবে শুকানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলে। এ জন্য ব্যবহার করা হয় ড্রায়ার। এর বাজার মূল্য ৩ থেকে ৪ লাখ। এই যন্ত্রটি ধান নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকিয়ে আনে যাতে ধানের গুণগত মান বজায় থাকে এবং সংরক্ষণে সহজ হয়। ড্রায়ার ব্যবহারে প্রাকৃতিকভাবে শুকানোর ওপর নির্ভরতা কমে ফলে সময় ও শ্রম—উভয়ই সাশ্রয় হয়।
পাওয়ার থ্রেসার
পাওয়ার থ্রেসার যা ধানের শীষ থেকে দানা দ্রুত ও সহজে আলাদা করে। আগে মাড়াই হাতে বা গরুর সাহায্যে করা হতো। এখন যন্ত্রের মাধ্যমে কম সময়ে বেশি কাজ সম্ভব। এটি দানার পাশাপাশি খড়ও আলাদা করে যা পশুখাদ্য বা জ্বালানির কাজে লাগে। এই যন্ত্রের দাম সাধারণত লাখ টাকার ওপরে হলেও এটি কৃষকের সময়, শ্রম ও খরচ বাঁচায়।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের কর্মকর্তা মো. ইখলাস আশরাফ আরও বলেন, ‘এসব যন্ত্রপাতির ফলে সময় ও শ্রম সাশ্রয় হচ্ছে এবং সহজেই ফসল সংরক্ষণ করা যাচ্ছে। অনেক কৃষক এখন এসব যন্ত্র কিনে সহজে কাজ করতে পারছেন। ফলে ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকট কিংবা অতিরিক্ত খরচের চাপ অনেকটাই কমে এসেছে। প্রযুক্তির এমন ব্যবহারের ফলে ধানচাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটছে।’