ঢাবির হলে সাত বছরে নির্যাতনের শিকার ২৮২ শিক্ষার্থী

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হলগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাগুলো সামনে এসেছে। ভয়ের সংস্কৃতি চালু থাকায় এতদিন চুপ থাকলেও আবরার হত্যার পর এ বিষয়ে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি ছাত্র হলের গেস্টরুম ও রাজনৈতিক কক্ষগুলো (পলিটিক্যাল রুম) সাধারণ ছাত্রদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কক্ষ ব্যবহৃত হয় ‘টর্চার সেল’ হিসেবে। গত সাত বছরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ৯২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৮২ জন শিক্ষার্থী। এদের কাউকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে, কাউকে পিটিয়ে হল থেকে তাড়িয়ে সিট দখল করা হয়েছে। নিজ সংগঠনের পদধারী নেতাকেও ‘ছাত্রদল-শিবির’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হলছাড়া করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। এরপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় নি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে, নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের ১৩টি হলে গ্রুপভেদে সপ্তাহে ৪-৫ দিন গেস্টরুম করানো হয়। ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের সিনিয়ররা গেস্টরুমে নবীন শিক্ষার্থীদের আচরণ শেখানোর নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। গেস্টরুমে নবীন শিক্ষার্থীদের আসা বাধ্যতামূলক। কেউ না আসলে তাকে দিতে হয় চড়া মাশুল। এছাড়া হলে উঠতে হলে শিক্ষার্থীকে যেকোন একটি গ্রুপের হয়ে ‘গণরুমে’ উঠতে হয়। কোন হলে সব গ্রুপের ‘কমন গণরুম’ আছে, আবার কোন হলে গ্রুপভিত্তিক পৃথক ‘গণরুম’। এসব গ্রুপের মধ্যে আবার সাব-গ্রুপ আছে। প্রতিটি গ্রুপ তার অনুসারী নেতাকর্মীদের পৃথকভাবে ‘গেস্টরুমে’ ডেকে নিয়ে যায়। এটি কখনও হলের অতিথি কক্ষে হয়, কখনও আবার রাজনৈতিক কক্ষগুলোতেও হয়।

সাধারণত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা- এভাবে শিক্ষাবর্ষ অনুযায়ী এই কক্ষে ডাকা হয়। কখনও কখনও আবার গ্রুপের প্রধান (হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী) সবাইকে নিয়ে ওই কক্ষে বসেন। এ ধরনের রুমে ডাকা মানেই ছোট বা বড় যেকোন ধরনের নির্যাতন অনিবার্য। তবে এসব ঘটনা নিয়ে মুখ খোলেন না কোন শিক্ষার্থী। কারণ, মুখ খোলাও চরম অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরিণামে মার খাওয়ার পাশাপাশি হলে অবস্থানের সুযোগ হারান শিক্ষার্থীরা।

বড় ভাইদের শিখিয়ে দেয়া কোনো কাজ না করলে শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। সেখানে চড়-থাপ্পড় দেয়া হতো। শাস্তি হিসেবে নির্দিষ্ট মেয়াদে (১ দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত) হল থেকে বের করে দেয়া হতো। অভিযোগ গুরুতর হলে শিক্ষার্থীদের ‘মিনি গেস্টরুমে’ ডাকা হতো। সেখানে তাদের ওপর চালানো হতো অমানসিক নির্যাতন। শীতের রাতে দাঁড়িয়ে গেস্টরুম করানোর ধকল সহ্য করতে না পেরে ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র হাফিজ মোল্লা মারা যান। এ ঘটনা তখন ব্যাপক আলোড়িত হয়। তারপরও থামেনি গেস্টরুম নির্যাতন। ডাকসু নির্বাচনের পরও থামেনি এই সংস্কৃতির চর্চা। কোন কোন হলে হল সংসদের নির্বাচিত ছাত্রলীগ নেতাদের তত্ত্বাবধানেই গেস্টরুম হয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী অধ্যয়নসহ ইতিবাচক ধারায় ‘গেস্টরুম’ পরিচালনার নজিরও পাওয়া গেছে কয়েকটি হলের অল্প কিছু গ্রুপে।

গেস্টরুমে কী শেখানো হয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জসিম উদদীন হলের প্রথম বর্ষের দু’ জন শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে হাঁটার সময় ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে হাঁটা, যাতে কোন বড় ভাইকে সালাম দেয়া মিস না হয়; দেখামাত্রই রাজনৈতিক বড় ভাইকে সালাম দিয়ে হাত মেলানো; হ্যান্ডশেক করার সময় বড় ভাইয়ের হাতে চাপ না দেয়া; হ্যান্ডশেকের পর হাত বুকে না লাগানো; হ্যান্ডশেকের সময় বাঁ হাত পেছনের দিকে রাখা; বড় ভাইয়ের সঙ্গে গার্লফ্রেন্ড থাকলে তাকে সালাম দেয়া; নিজ থেকে বড় ভাইয়ের কাছে কিছু জানতে না চাওয়া, শুধুমাত্র বড় ভাই কিছু বললেই তার জবাব দেয়া; বড় ভাইদের সামনে না হাসা; ক্যান্টিন, পাঠকক্ষ ও টিভিরুমে জ্যেষ্ঠদের আসনে না বসা; দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের না জানিয়ে সিনিয়রদের কাছে বিচার না দেয়া; ইমিডিয়েট সিনিয়র ছাড়া সিনিয়রদের থেকে ছুটি না নেয়া; ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে হলে ইমিডিয়েট সিনিয়রদের মোবাইলে কল দিয়ে ছুটি নেয়া, ছুটি না পাওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বাইরে না যাওয়া; বাড়ি যাওয়ার জন্য বা অন্য কোন কারণে ছুটির প্রয়ো জন হলে লিখিত আবেদন নিয়ে বড় ভাইদের কক্ষে যাওয়া; প্রত্যেকের ফেসবুক প্রোফাইলে ছাত্রলীগের ‘রাজনৈতিক কর্মী’ যোগ করা; ফেসবুকে ছাত্রলীগের বড় ভাইদের পোস্টে কমেন্ট করা; প্রথম বর্ষ শেষ হওয়ার আগে হলের পাঠকক্ষে না যাওয়া; স্যান্ডেল, ট্রাউজার ও গোল গলার টিশার্ট পরে গেস্টরুমে না আসা।

গণরুমে থাকা অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে সংবাদের। তারা বলছেন, ক্যাম্পাসে কেউ ইচ্ছা করে রাজনীতি করে না। শুরুতে তাদের দিয়ে বিভিন্ন অপরাধ করানো হয়, পরে যখন সে খারাপ কাজে জড়িয়ে যায়, সেই নেতারাই তাদের উদ্ধার করে। পরে বাধ্য হয়ে তাদের রা জনীতিতে সক্রিয় থাকতে হয়। শিক্ষার্থীরা বলেন, হল প্রশাসন সিট বণ্টন এবং তা তদারকি করলে রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাবে। এর ফলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করতে পারবে না।

ছাত্রলীগের নির্যাতনের খতিয়ান

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ৯২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে ২৮২ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ১ জন, ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ২ জন, ২ ফেব্রুয়ারি এ হলের ৬ জন ও বিজয় একাত্তর হলের ১ জন, ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি ৫ জন, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ২ জন এবং ২৬ সেপ্টেম্বর ১ জনকে মারধর করে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। স্যার এএফ রহমান হলে গত বছরের ২৪ মার্চ ১ জন, একই বছরের অক্টোবরে ১ জন, ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ৪ জন, ২৩ জুলাই ৩ জন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি ৮ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে চলতি বছরের ১৩ জুলাই ২১২ নম্বর কক্ষে ২৫ জন, গত বছরের ২৪ মে ২০৮ নম্বর কক্ষে ৩৫ জন, ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট ২২৭ নম্বর কক্ষে ১ জন, ২৭ জুলাই ২ জন, ২ ফেব্রুয়ারি ৮ জন, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ১ জন, ২১ ডিসেম্বর ২ জন, ১ ডিসেম্বর ১ জন, ২৬ আগস্ট ১ জন, ২৯ জুলাই ৩ জন, ২৯ মে ১ জন এবং ৯ ফেব্রুয়ারি ২ জন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নেতাদের মারধরের শিকার হয়েছেন। বিজয় একাত্তর হলে চলতি বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ১ জন, ২২ এপ্রিল ১ জন, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ১ জন, একই বছরের অক্টোবরে ১ জন, ২৩ মার্চ ২ জন, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১ জন, ১৬ জানুয়ারি ১ জন, ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট ১ জন, একই বছরের জুন মাসে ১ জন এবং ২০১৫ সালের ২ আগস্ট নিজ সংগঠনের কর্মীসহ ৩ জনকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

জসিম উদদীন হলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১ জন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২১৫ নম্বর কক্ষে ১ জন, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ৩ জন এবং ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট ১ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। মাস্টারদা সূর্যসেন হলে চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৫ জন, ২৫ জুলাই ২৩৭ নম্বর কক্ষে ১ জন, ২০১৭ সালের ৪ মার্চ ১ জন, ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর ১ জন, ১৯ নভেম্বর ৩ জন, ১ অক্টোবর ১ জন, ৩ মার্চ ১ জন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ১ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ৩০ ছাত্রকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে গত বছরের ১০ অক্টোবর ১ জন, ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট ৫ জন, ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি ১ জন, ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ১ জন, ৬ সেপ্টেম্বর ৩ জন, ১১ সেপ্টেম্বর ১ জন, ১০ সেপ্টেম্বর ৩৩৭ নম্বর কক্ষে ২ জন, ২৩ জুলাই ৩ জন, ১৬ জুলাই ১ জন এবং ১০ ফেব্রুয়ারি ৩ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতারা।

সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে চলতি বছরের ২ এপ্রিল ১ জন, ১ মার্চ ১ জন, গত বছরের ২১ নভেম্বর ১ জন, ৩০ সেপ্টেম্বর ২ জন, ৬ ফেব্রুয়ারি ১ জন, ২০১৭ সালের ১১ আগস্ট ১ জন, ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর ২ জন, ২০১৫ সালের ৪ মার্চ ১ জন, ২২ ফেব্রুয়ারি ২ জন, ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ২ জন, ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৪ জন, ১২ ডিসেম্বর ৪ জন, ৩০ অক্টোবর ৯ জন, ২৭ অক্টোবর ১ জন, ২৭ সেপ্টেম্বর ১০ জন, ১৭ জুলাই ১ জন, ১০ এপ্রিল ৮ জন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ৬ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করে হল শাখা ছাত্রলীগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৯ জন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে ৩০৬ নম্বর কক্ষে হল ছাত্রলীগের এক নেতাকে হাত পিছমোড়া করে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে চোখে গামছা পেঁচিয়ে রড দিয়ে পেটানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের এক নেতাকে হলছাড়া করা হয়েছিল, যাকে পরবর্তীতে ছাত্রলীগই হলে তোলে। তিনি এখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা। এ হলে ২০১৭ সালে ৩ জন, ২০১৩ সালে দুই ছাত্রলীগ নেতাসহ ১৪ জনকে পিটিয়ে আহত করা হয়।

জগন্নাথ হলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২ জন ও ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ১০ জন শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ২ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া, ২০১৮ সালের ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে না যাওয়ায় ১০ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয় শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। অমর একুশে হলে ২০১৪ সালের ৩ মার্চ রাতে ৩ জন শিক্ষার্থীকে মেরে থেকে বের করে দেয় হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে গত বছরের ৬ আগস্ট ৬ জন এবং ৮ মার্চ ১ জন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হন। সুফিয়া কামাল হলে গত বছরের ১০ এপ্রিল ১ছাত্রী ছাত্রলীগ নেত্রীদের নির্যাতনের শিকার হন।

এছাড়া, গত ৩ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলায় ৯ ছাত্রদল নেতা ও গণমাধ্যমে ৩ ক্যাম্পাস প্রতিনিধি আহত হন। এর আগে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি মল চত্বরে ১ জন, গত বছরের ১ নভেম্বর টিএসসিতে ১ জন, ২৫ অক্টোবর টিএসসিতে ২ জন, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে চারুকলার সামনে ১ জন, ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিনে ২ জন, ১২ জুন মধুর ক্যান্টিন এলাকায় ১ জন ও ১ মার্চ ফুলার রোডে ১ জন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব ঘটনার বাইরেও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থী হয়রানির খবর পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিট দখলের মাধ্যমে হলে আধিপত্য বিস্তার করেই এ ধরনের অন্যায় কাজে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। তবে ছাত্রী হলগুলোতে গণরুমের চিত্র অনেকটা আলাদা। সেখানে গণরুম বললেও ছাত্র হলের মতো মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র নেই।

ছাত্র হলগুলোর টর্চার সেল

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলের ২০৫, ২০৭, ২১২, ২২৩, ২২৪, ২২৫, ২২৭, ৩০৫ ও ৩২২ নম্বর কক্ষসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক কক্ষই টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত ছিল। বিজয় একাত্তর হলের ৩০০২ (যমুনা), ৫০০৮ (যমুনা), ৮০০৬ (যমুনা) ও ৮০০১ (পদ্মা) নম্বর কক্ষে শিক্ষার্থী নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ আছে। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩০০২ (যমুনা), ৮০০৬ (যমুনা) ও ৮০০১ (পদ্মা) নম্বর কক্ষে। ৩০০২ নম্বর কক্ষে থাকতেন হল ছাত্রলীগের সভাপতি ফকির রাসেল, যিনি আঞ্চলিক রাজনীতির মারপ্যাচে এখন হলছাড়া। ৮০০৬ নম্বর কক্ষে থাকেন হল সংসদের এজিএস ও হল শাখা ছাত্রলীগের সিনিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ইউনুস, যে কক্ষটি ‘দেউরি’ নামে পরিচিত। নিজের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে তিনি নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করতেন। এর আগে তিনি শিক্ষার্থী মারধরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। ৮০০১ নম্বর কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন সম্পাদক ও হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন শাহাদাৎ। তার কক্ষে নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীকে মারধরের প্রমাণ আছে। জসিম উদদীন হলের ২১৫ নম্বর ও ৪৩২ নম্বর কক্ষে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। মাস্টারদা সূর্যসেন হলের ৩১৫ ও ৩৫১ নম্বর সহ একাধিক কক্ষ টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ৩৩৩, ৩১৫, ৩২৭ ও ২০৫ সহ একাধিক কক্ষে শিক্ষার্থী নির্যাতন চলত। তবে, ডাকসু নির্বাচনের পরে ছাত্রদের সব হলে গেস্টরুম এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কক্ষগুলোই টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত।

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে শিবির সন্দেহে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা না ঘটলেও বিগত সময়ে বিভিন্ন অভিযোগে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে গেস্টরুম ও ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ না নেয়ায় সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের এক শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে ডেকে ‘শিবির’ অপবাদ দিয়ে চড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি শিবির অপবাদ দিয়ে এসএম সজীব নামে এক শিক্ষার্থীকে দুই দফা পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেলের অনুসারীরা। তবে, তার সঙ্গে শিবিরের কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। উল্টো তার নামে শাহবাগ থানায় ছাত্রদলের হয়ে গাড়ি ভাঙচুরের একটি মামলা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী এসএম সজীব বলেন, আবরারকে যেভাবে মারধর করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে আমাকেও স্ট্যাম্প দিয়ে আলাদা দুটি কক্ষে নিয়ে দুই দফা মারধর করা হয়েছে। আমি কোনভাবেই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর এ রায় বাংলায় অনুবাদ করি। এরপরও আমাকে শিবির অভিযোগ দিয়ে পেটানো হলে সেটা মেনে নিতে পারি না। যেদিন রাতে আমাকে মারধর করা হয়, সেদিন ছিল অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। এ নিয়ে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দেই। এরপর আর কি প্রমাণ লাগে যে, আমি শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না।

সজীব জানান, এ ঘটনায় তিনি এসএম হলের প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ জানান। কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণ করার বদলে প্রক্টর উল্টো তাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কিছু বলবে না’। একই বছরের ১১ আগস্ট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গাঁজা সেবনে বাধা দেয়ায় বিজয় একাত্তর হলের এক শিক্ষার্থীকে ‘শিবির’ অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তবে, সে শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিবিরের রাজনীতির সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। আল আমিন হাওলাদার নামের ওই শিক্ষার্থী জানান, হলের পদ্মা ভবনের নবম ও দশম তলায় নিয়মিত গাঁজা সেবন করত ছাত্রলীগের ৭-৮ জন নেতাকর্মী। তিনি তার কক্ষের সামনে গাঁজা সেবন করতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বারণ করেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে তাকে ‘শিবির’ অপবাদ দিয়ে মারধর করা হয়। তিনি জানান, হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নয়ন হাওলাদারের কক্ষে শিবিরের কিছু বই থাকত। কাউকে শিবির অভিযোগে মারধর করা হলে তার হাতে এসব বই ধরিয়ে দিয়ে ছবি তোলা হতো এবং প্রচার করা হতো যে, শিবিরের বইসহ সে শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া, ফেসবুকের কিছু ফেক স্ক্রিনশট বানিয়ে মারধরকারী শিক্ষার্থীকে জোর করে শিবির বানানোর চেষ্টা করা হতো।

এসব বিষয়ে অবহিত করলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, আমরা নেতাকর্মীদের নিশ্চিত করেছি যে, গেস্টরুম বা গণরুমকেন্দ্রিক সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধরের কোন অভিযোগ যেন আমাদের কাছে না আসে। এরপরও যদি আমাদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ আসে, আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তিনি বলেন, গেস্টরুমকে আমরা ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসতে চাই। গেস্টরুমে শিক্ষাভিত্তিক কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। লেখক বলেন, শিক্ষার্থীদের নির্যাতনে আমাদের সাংগঠনিক কোন নির্দেশনা থাকে না। এরপরও কেউ অতিউৎসাহী হয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করলে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

হল প্রশাসন সিট বণ্টন করলে শিক্ষার্থী নির্যাতন কমে যাবে শিক্ষার্থীদের এ ধারণার কথা জানালে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূইয়া তার অসহায়তার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, অতীতেও এমন (সিট বণ্টন) হয়নি। তাদের (ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন) জন্য পারিনি। তবে, প্রভোস্ট কমিটির সভার পর হল প্রশাসনের মাধ্যমে সিট বণ্টনের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে মুহসীন হলের এ প্রাধ্যক্ষ বলেন, বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে আমাদের কাছে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অনেক অভিযোগ আসে। আমাদের হলে সিনিয়ররা জুনিয়রদের ধমক দেয়। তবে কোন টর্চার সেল নেই। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ আসলে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এ সকল (টর্চার সেল) ধারণার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে না। কোন ঘটনা (নির্যাতনের) ঘটলে শিক্ষার্থীরা যেন হল প্রশাসনকে অবহিত করে। তাহলে আমরা কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করব। সংবাদ


সর্বশেষ সংবাদ