নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগ ও জিনিয়ার গল্প!

মেয়েটির বহিষ্কারের ঠিক দু’দিন পর আমার সাথে যেদিন প্রথম কথা হয়েছিল, সেদিন ও আমাকে বলেছিল, এখানকার সাংবাদিক নেতারা (সহকর্মীরা) ম্যানেজড, কিন্তু আমি আমার জায়গায় স্ট্রং থাকবো। লড়াইটি খুব কঠিন কিন্তু অন্যায়ের কাছে হারতে চাই না।

সমগ্র প্রশাসন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কথায় উঠবস করে, বহিষ্কারের মিছিল এতোটায় দীর্ঘ যে কেউ উপাচার্য নাসিরউদ্দিনের সামনে কথা বলার সাহস পায়নি সেখানে এই মেয়ের ওই একটি বাক্যে আমার মনে দাগ কাটে। নিজের প্রতি পূর্ণ আস্থা যার অবিচল তার জয় অবশ্যই আসবে। জিনিয়ার কথার প্রতি বিশ্বাস রেখে ওর পাশে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ওর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালাবো।

জিনিয়া আমার ছোট বোনের বয়সের চেয়েও ছোট। তাই ও বোনের আসনটি খুব সহজে নিতে পেরেছে। দ্বিতীয় দিনের কথায় ওর কাছে বেশ কিছু তথ্য পেলাম, যা সত্যি আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। উপাচার্য যে দাবি নিয়ে জিনিয়াকে বহিস্কার করেছিল, সেই দাবিটি যে নেহাত একটি বড় দুর্নীতিকে চাপা দেয়ার চেষ্টা তা সহজে আঁচ করতে পেরেছিলাম। তবে মেয়েটি দূভাগ্য যে তার সহকর্মীরা উপাচার্যের কথায় উঠে আর বসে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির নেতাদের উপাচার্য যেভাবে কব্জা করেছিল, তাতে মনে হয়েছিল, মেয়েটিকে এই শয়তানের রাহু থেকে মুক্তি করা কিছুটা হলেও কষ্টকর হবে। কতটা নির্বোধ জিনিয়ার সহকর্মীরা যে তাদের হাতে লাঠি থাকার পরও সামন্য একটি তেলোপোকার ভয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল।

জিনিয়ার কাছ থেকে যখন জানতে পেলাম, ওই সাংবাদিক সমিতির একজন নেতা উপাচার্যের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ পেয়েছিল, তখন বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নামে-বেনামে অর্থ ছিটিয়ে সবাইকে হাতে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংবাদকর্মী যেমন হাতে রেখেছিল ঠিক তেমনি শহরের সাংবাদিকরাও উপাচার্যের কথা কখনো ফেলেন না। যে কারণে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রতিবাদ-আন্দোলনও কাভারেজ পায়নি। যার সুযোগে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হয়রানীর মধ্যে পড়তে হয়েছে।

যাই হোক, সবকিছু বিশ্লেষণ করে, আমার কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট, যে মেয়েটিকে এই উপাচার্যের রাহু থেকে উদ্ধার করতে হলে, আমাদের গণমাধ্যমকে অবশ্যই শক্তিশালী একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। এটা করতে না পারলে, এই বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই অন্ধকার থেকে বের হতে পারবে না।

বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম ফেইসবুকে। আমি সত্যি কৃতজ্ঞ আমাদের গণামাধ্যমের প্রতি যারা অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠতার সাথে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক ঘটনা তুলে ধরেছে। হাউজগুলো থেকে বিশেষ প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিশেষ বিশেষ সংবাদ পরিবেশন করেছে।

এরমধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশ কিছু দুর্নীতির ডকুমেন্ট হাতে জমা পড়েছে। বিদেশের মাটিতে লেখালেখি করলোও বাংলাদেশে সাংবাদিকতা থেকে বেশ দূরে ছিলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না যে ওইসব দুর্নীতির সংবাদ আমি করবো কী না?

তবে এই বোনটির মুখের দিকে চেয়ে, সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রতিবেদন করবো। হোক না বিদেশ, সংবাদটি হবে একজন চিহিৃত দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্ধকার থেকে ফেরাতে, কিছু সময় ব্যয় না হয় হলো।

১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ছাত্রনেতা, গ্রন্থাগারের সাথে যেদিন প্রথম কথা বলেছিলাম, সেদিন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা দুর্নীতি হয়েছে। অসংলগ্ন কথাবার্তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল নাসিরউদ্দিনের দুর্নীতির খাতা।

যাইহোক, মেয়েটিকে এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হচ্ছিল, যে সে যদি ক্ষমা চায়, তাহলে তার বহিস্কারদেশ তুলে নেয়া হবে। শুধু তাই নয়, সব কিছুর সমাধান হয়েছে মর্মে ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ানোর অনুরোধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমি জিনিয়াকে বলেছিলাম, তুমি যদি অন্যায় না করে থাকো, তাহলে জয় তোমার নিশ্চিত। সুতারাং ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তুমি তোমার নৈতিক জায়গায় ঠিক থাকো, দেখবো সত্যের জয় তোমার ঘরে আসবে।

মেয়েটি শুধু একটা কথায় বললো, জ্বি ভাইয়া, আমি কখনোই ক্ষমা চাইবো না। যাই হোক, এমন দৃঢ়তা যার কন্ঠে সেখানে অন্যায়কারীরা মাথা নত করবে এটাই স্বাভাবিক। জিনিয়ার ছাত্রত্ব বহিস্কারদেশ তুলে নেয়া হলো। এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় নেমেছে, মার খেয়েছে, রৌদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে টানা ১২ দিন আন্দোলন চালিয়ে গেছে। এই আন্দোলনে শিক্ষক নামক অভিভাবকরা চাকরি হারনোর ভয়ে দূরে ছিল, তবে এদের মধ্যে বেশ কিছু সাহসী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে মুক্তা আপু অগ্রগণ্য।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে শিক্ষাছুটিতে থাকা এই শিক্ষক ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জে ছেলে-মেয়েদের পাশে থেকে সাহসটুকু দিয়ে গেছেন। দেশের বাহিরে বেশ কিছু শিক্ষকও এইসব শিক্ষার্থীদের পাশে একাত্মতা ঘোষণা করে। দিনশেষে অন্যন্য শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সমন্বিত আন্দোলনে নাসিরউদ্দিনদের ক্ষমতার নড়চড় শুরু হয়।

একটি ২০/২১ বছরের মেয়ে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। কিভাবে পাহাড়সম ক্ষমতাবানদের সত্যের চাবুক দিয়ে চপেটাঘাত করতে হয়। কিভাবে বিবেকের বন্ধ জানালায় আঘাত করে বিবেকবানদের প্রতিবাদী করতে হয়, তা আমার এই ছোট বোনটি দেখিয়ে দিয়েছে।

ওর বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাজিত হয়েছে নাসিরউদ্দিনদের কথিত উচ্চশিক্ষা। নৈতিকতার স্থূলন হলে যে দেবালয়ও পুড়ে যায়, তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি একটি করে জিনিয়া থাকতো, তাহলে কোটি টাকার সেলামি, স্বীয় সনদদাতা, শিক্ষক-বাণিজ্য, পরিবারতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসনকর্তারা অন্যায় করার আগে কয়েকশোবার ভাবতো।

আজ হয়তো নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগই অনেকেই আনন্দিত। কিন্তু আমি মোটেই খুশি নই। উনার পদত্যাগই সমাধান নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গত সাড়ে চার বছরে যতগুলো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার প্রতিটি গোড়া থেকে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। যেভাবে দুর্নীতি হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। নাসিরউদ্দিনের ব্যাংক আকাউন্ট জব্দ করা থেকে শুরু করে তার যাবতীয় দুর্নীতি দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে হোক, যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর কোন দ্বিতীয় নাসিরউদ্দিন ফিরে না আসে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ