ফ্রি ফায়ার-পাবজির আসক্তি থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে

অনলাইন গেম
অনলাইন গেম  © সংগৃহীত

স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলার প্রতি শিশু-কিশোরদের আসক্তি নতুন কিছু নয়। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক ধরে এই আসক্তি থেকে দেশে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। সর্বশেষ গত রবিবার (৩০ মে) ও সোমবার (৩১ মে) ফ্রি ফায়ার-পাবজি গেম কেড়ে নিলো দুই কিশোরের প্রাণ।  

পাবজি-ফ্রি ফায়ারসহ শিশু-কিশোরদের অধিকাংশ গেম সন্ত্রাসী ধরনের হয়ে থাকে উল্লেখ করে এসব নিষিদ্ধের আহবান জানিয়েছে তথ্য প্রযুক্তিবিদদের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইনফরমেশন সিস্টেম অডিট অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন (আইসাকা) ও বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন)। সোমবার (৩১ মে) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানিয়েছে সংগঠন দুটি।

মনরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ের ফলে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এসব গেমিংয়ের আসক্তি থেকে আত্মহত্যার মতো পথও বেঁচে নিতে পারে। তাই তাদের রক্ষা করতে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। 

জানা গেছে, মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দীর্ঘ ১৫ মাস বন্ধ দেশের সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনার সময়টা এখন বিভিন্ন গেমের পেছনে ব্যয় করছে শিশু-কিশোররা। এর ফলে পড়াশোনার ক্ষতির পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। 

শুধু তাই নয়, এসব গেম খেলতে না দেয়ায় অভিভাবকের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে গত দুই সপ্তাতে চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, পাবনা ও বগুড়ায় ৪ কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।

সর্বশেষ এ তালিকায় যুক্ত হলেন পাবনার দরিদ্র পরিবারের সন্তান আসিফ (১৮)। ফ্রি ফায়ার-পাবজি গেম খেলার জন্য বাবার কাছে স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার আবদার করেছিল সে। কিন্তু দরিদ্র বাবা তাকে স্মার্টফোন কিনে দিতে পারেননি। তাই অভিমানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন আসিফ।

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নের খান মাহমুদপুর গ্রামে গত সোমবার (৩১ মে) বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আসিফ ওই গ্রামের সেলন ফকিরের ছেলে।

এর আগের দিন রবিবার (৩০ মে) সাতক্ষীরায় চিরকুটে লিখে গলায় রশি দিয়ে শোবার ঘরের আড়ায় ঝুলে আত্মহত্যা করেছে আশিক রহমান নামের এক স্কুলছাত্র (১৫)। 

ঘটনার দিন দুপুরে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের পাঁচশত বিঘা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আশিক ওই গ্রামের ওমানপ্রবাসী বাবর আলী মল্লিক ও খাদিজা আক্তার দম্পতির বড় ছেলে। পাতড়াখোলা আরশাদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।

চিরকুটে তিনি লেখেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না, আইডির পাসওয়ার্ড। ফ্রি ফায়ার পাবজি গেমের আইডিতে ঢুকে তোমরা কাজ করতে পারবা। আমি যে আইডি কিনেছি, তা বিক্রি করে টাকাটা তাদের ফেরত দিও।’

গত ২১ মে চাঁদপুরে স্মার্টফোনে 'ফ্রি ফায়ার' গেম খেলার জন্য ইন্টারনেট কেনার টাকা না পেয়ে মামুন (১৪) নামের এক কিশোর আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ২৪ মে বগুড়ায় স্মার্টফোনে ‘ফ্রি ফায়ার গেম’ খেলতে না দেওয়ায় চিরকুট লিখে উম্মে হাবিবা বর্ষা (১২) নামে এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তিনি বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল।

বর্ষা চিরকুটে লেখেন, ‘বাবা-মা আমাকে ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে দিত না। বকাঝকা করতো। তাই আমি চলে গেলাম। আমাকে আর বকাঝকা করতে হবে না’।

এক বিবৃতিতে আইসাকা ও সিসিএ ফাউন্ডেশন বলছে, এখনকার তরুণদের খেলা প্রায় সব ভিডিও গেম সন্ত্রাসী ধরনের হয়ে থাকে। কীভাবে একজনকে মেরে একটি শহর দখল করা যায়, কীভাবে একটি জাতিকে শেষ করে দেওয়া যায়, তা তরুণেরা ভিডিও গেমস থেকে শিখছে। ফলে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং তৈরির মাধ্যমে সহিংস ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এর থেকে পার পেতে হলে পরিবার ও রাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকরী উদ্যোগ নিয়ে ‘সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম বলেন, গেমিংয়ে আসক্তি বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত পরিস্থিতিই দায়ী। যেহেতু করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ফলে বাচ্চাদের আসক্তির কারণ হচ্ছে তারা প্রচুর সময় পাচ্ছে। এই সময়ে যেহেতু পারিপার্শ্বিক কাজ নাই, বাইরে যেতে পারছে না। ফলে বেশিরভাগ বাচ্চারা অনলাইন ভিডিও গেমস কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সময় ব্যয় করছে। মূলত সময়ের অপব্যবহারই আসক্তিকে বাড়াচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সাময়িক মানসিক একটা প্রশান্তি পেয়ে বাচ্চারা অনেকক্ষণ গেম খেলছে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ের ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সুদুরপ্রসারি চিন্তা করলে পরবর্তীতে এটির প্রভাব আরও বেড়ে যাবে।

ফ্রি ফায়ার-পাবজির মতো গেম বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা, এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এটা শুধু এককভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় রয়েছে, সবাই একযোগে কাজ করবে। কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যসহ সকল বিষয়ে নিরাপদ রাখা, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।


সর্বশেষ সংবাদ