১৭ কোটি টাকার কেনাকাটায় ১২ কোটিই লোপাট
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৫ মে ২০১৯, ০৭:৫৯ PM , আপডেট: ২৫ মে ২০১৯, ০৮:০২ PM
বরাদ্ধের ১৭ কোটি টাকার কেনাকাটায় প্রায় ১২ কোটি টাকাই লোপাট হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালের কেনা-কাটার ক্ষেত্রে এমন দুর্নিতীর খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে পণ্য সরবরাহ না করেই জাল স্বাক্ষরে বিল তুলে নিয়েছে এর সঙ্গে জড়িত চক্রটি। জড়িতদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
হাসপাতাল দুটির জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৭ কোটি টাকা দামের একটি সফটওয়্যার এবং প্রায় ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। কাগজে-কলমে এসব কেনা হলেও বাস্তবে অধিকাংশ যন্ত্রপাতির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ৭ কোটি টাকা মূল্যে কেনা সফটওয়্যারের কোন অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১০ কোটি টাকার পণ্যের মধ্যে প্রায় ৫ কোটি টাকার পণ্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে ১২ কোটি টাকাই লোপাট। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট একটি চক্র যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই এ অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
জানা গেছে, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ কোটি টাকা মূল্যমানের ‘পিকচার আর্কাইভিং কমিউনিকেশন সিস্টেম (পিএসিএস) নামের একটি সফটওয়্যার কেনা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে বিল জমা দিলে ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তত্ত্বাবধায়ক স্বাক্ষর করেন।
গত এপ্রিলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের একটি পরিদর্শন কমিটি সেখানে পরিদর্শনে গেলে এই সফটওয়্যারের কোনো অস্তিত্ব পায়নি।
একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটি সফটওয়্যার দেখতে চাইলে তা দেখাতে পারেননি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ শাহজাহান আলী। এমনকি এটি কেন কেনা হয়েছে, কীভাবে ব্যবহার করা হবে- সে বিষয়েও বিস্তারিত বলতে পারেননি তিনি।
জানা গেছে, পিকচার আর্কাইভিং কমিউনিকেশন সিস্টেম (পিএসিএস) নামের এ সফটওয়্যারটি সাধারণত যে কোনো ধরনের ডিজিটাল ইমেজিং মেশিনে ছবি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশেষ করে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, সিটিস্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি মেশিনে এটি ব্যবহার করলে দেশে বা দেশের বাইরে চিকিৎসার্থে গেলে নির্দিষ্ট রোগীর রিপোর্ট ও ইমেজ সেখানে পাওয়া যাবে। তবে এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসান বলেন, অধিদফতর থেকে কোনো কিছুই কেনা হয় না। সবসময়ই স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক বা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে যে ক্রয় প্রস্তাব আসে তার পরিপ্রেক্ষিতেই মালামাল কেনা হয়ে থাকে।
এদিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় দশ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়। দুটি আলাদা বিলে এ টাকা পরিশোধ করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান। একটি বিলে ১৬ আইটেমের ৩৬টি যন্ত্রপাতির বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫০ টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৩টি আইটেমের ২০টি যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যার দাম এক কোটি ৬১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। বাকি যন্ত্রপাতির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে অপর বিলে ৩টি আইটেমের ৯টি যন্ত্রপাতির বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। যার মধ্যে রয়েছে ৪টি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন। এর প্রত্যেকটির দাম ধরা হয়েছে ৮৭ লাখ টাকা। যেখানে সর্বাধুনিক আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের দাম ৩০-৩৫ লাখ টাকা।
কেনাকাটার বিষয়ে কথা বলার জন্য সাতক্ষীরা জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি বর্তমানে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সাতক্ষীরায় তার সাবেক কর্মস্থলে গিয়েও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় কিন্তু কোনোভাবেই তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা জেলার বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ওই সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে মালামাল সরবরাহের আগেই বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদার। তাই মন্ত্রণালয় থেকে যখন পরিদর্শক দল এসেছে তারা যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব পায়নি। তবে সরবরাহকারী ঠিকাদার কিছু কিছু করে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে।
এ ছাড়া হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, ডা. তৌহিদুর রহমান কাউকে না জানিয়েই এসব কেনাকাটার তালিকা প্রস্তুত করেন। বিভাগীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই তাদের নাম ক্রয় সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। কেনাকাটা সম্পন্ন হলে বিল দেয়ার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। অসুস্থ অবস্থায় ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে যাদের নাম রয়েছে তাদেরকে হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এসব চিকিৎসক হাসপাতালে তাকে দেখতে গেলে তাদের দিয়ে কৌশলে বিভিন্ন ফাইলে স্বাক্ষর করিয়ে নেন।
এদিকে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের একটি পরিদর্শন দল গত ৯ এপ্রিল সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল এবং সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে যায়। সেখান থেকে ফিরে তারা কর্তৃপক্ষ বরাবর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম দুই ত্রৈমাসিকে ভারি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট অপারেশনাল প্ল্যান থেকে মোট ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসান বলেন, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালের কেনাকাটা সংক্রান্ত জটিলতার এ বিষয়টি তিনি জানেন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, পরিদর্শন কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেই আলোকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদি কেউ অনিয়ম করে থাকে তবে ছাড় পাবে না।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা অধিশাখা) বেগম জাকিয়া সুলতানা বলেন, সাতক্ষীরার এ বিষয়টিসহ আরও এমন একাধিক বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন হলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।