ঢাকায় সিরিজ অগ্নিকাণ্ড, পুলিশ বলছে ‘ইঞ্জিন ত্রুটি-মেকানিকের ভুল-সিগারেটের আগুন’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৭ PM , আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৯ PM
বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতেই তারা এ কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীতে উত্তেজনা বিরাজ করছে, এরই মধ্যে মঙ্গলবার রাজধানীজুড়ে ঘটে গেছে পরপর কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড ও সহিংসতার ঘটনা। যদিও পুলিশ বলছে, এসব ঘটনার নেপথ্যে অরাজক পরিস্থিতি নয়, বরং ইঞ্জিন ত্রুটি, সিগারেটের আগুন ও মেকানিকের ভুল।
আজ (মঙ্গলবার) সকালে থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পরপর তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, উত্তরায় একটি মাইক্রোবাসে, রমনায় একটি পুলিশ ভ্যানে এবং মিরপুরে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। এছাড়াও সন্ধ্যার পর ধোলাইপাড়ে একটি বাসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাগুলোকে ‘দুর্ঘটনা’ বলে দাবি করলেও স্থানীয় বাসিন্দা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
তাদের অভিযোগ, এসব অগ্নিকাণ্ডের সময় ও পরিস্থিতি অত্যন্ত সন্দেহজনক, কারণ আগামীকাল (বুধবার) নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের ডাকা ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি এবং অপসারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার গুরুত্বপূর্ণ শুনানির ঠিক আগেই ঘটনাগুলো ঘটেছে। নিরাপত্তা আগেই জোরদার করা হলেও, অনেকের ধারণা— এই অগ্নিকাণ্ডগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হতে পারে অরাজকতা তৈরির উদ্দেশ্যে।
যারা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে তাদেরকে আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করে অপতৎপরতা দমন করা হবে। রাজধানীতে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারীদের পাশাপাশি তাদের নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আজকেও প্রায় অর্ধশত নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।- শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা
রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েকটি হামলার ঘটনাও ঘটে। এগুলোর মধ্যে যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় বাসে অগ্নিসংযোগ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দপ্তরসংলগ্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ অন্তর্ভুক্ত। আজকের বড় তিনটি ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও শহরজুড়ে আতঙ্ক ও যানজট সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের টহল জোরদার হওয়ায় রাজধানীর সড়কগুলো ছিল অস্বাভাবিকভাবে ফাঁকা, এমনকি মেট্রোরেলেও যাত্রী সংখ্যা ছিল কম।
আরও পড়ুন: ‘মিস্ত্রির ভুলে’ থানার সামনে পুলিশের গাড়িতে আগুন
সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে উত্তরা জসিম উদ্দিন রোডে একটি হায়েস মাইক্রোবাসে আগুন ধরে যায়। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, তবে কেউ আহত হয়নি। বিমানবন্দর থানার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ঘটনাটির সঙ্গে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, ইঞ্জিন স্পার্ক থেকেই আগুন লাগে।” তিনি জানান, পুলিশ বিশেষ দায়িত্বে থাকাকালে ধোঁয়া দেখতে পেয়ে উপপরিদর্শক সানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়িটিকে জ্বলতে দেখে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়।’
গাড়িচালক মো. মনি হোসেন (৪৫) বলেন, ‘আমি পারটেক্স গ্রুপের এজিএম আনোয়ার সুমনকে মহাখালী থেকে নিতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ইঞ্জিনে আগুন ধরে।‘ তবে এর কয়েক ঘণ্টা আগে ভোর ৪টার দিকে একই এলাকায় একটি রাজধনী পরিবহনের বাসেও দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। অনলাইনে পোস্টে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে দায়ী করা হলেও পুলিশ তা গুজব বলে জানিয়েছে। স্থানীয়দের প্রশ্ন, ‘একই এলাকায় কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি অগ্নিকাণ্ড? বিষয়টা নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয়।’
পরে সকাল ১১টার দিকে কাকরাইলে রমনা মডেল থানার ঠিক সামনে একটি পুলিশ পিকআপ ভ্যানে আগুন ধরে যায়। থানা সূত্র জানায়, ভ্যানটি আগে থেকেই বিকল ছিল এবং সেটির মেরামতের সময় ইঞ্জিনে আগুন লাগে। এতে একজন মেকানিক সামান্য দগ্ধ হন। থানা কর্মকর্তারা দ্রুত আগুন নেভান।
আরও পড়ুন: এবার পুলিশ বলল ‘সিগারেট থেকে মিরপুরের বাসে আগুন’
রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম ফারুক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ আগুন কোনো দুর্বৃত্ত দেয়নি। গাড়ির কাজ করার সময় হঠাৎ আগুন লেগে যায়। ওসি বলেন, গাড়ির কাজ করার সময় হঠাৎ ব্যাটারি সংযোগ এক হয়ে আগুন লেগে যায়। পরে অবশ্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আগুনে কোনো হতাহত নেই। গাড়ির মিস্ত্রির ভুলে এ আগুনের ঘটনা ঘটে। তবে এই ক্যান্ড কোনও দুর্বৃত্ত করেনি।
তিনি জানান, গাড়ির কাজ করার সময় হঠাৎ ব্যাটারি সংযোগ এক হয়ে আগুন লেগে যায়। পরে অবশ্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আগুনে কোনও হতাহত নেই। গাড়ির মিস্ত্রির ভুলে এ আগুনের ঘটনা ঘটে বলে জানান রমনা থানার ওসি গোলাম ফারুক।
এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া বিভাগের প্রধান মো. তলেবুর রহমান এক বিবৃতিতে জানান, ‘এটা নিছকই একটি যান্ত্রিক দুর্ঘটনা, অনলাইনে ছড়ানো বানোয়াট গল্পে বিভ্রান্ত হবেন না। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আগুন লাগার আগে কয়েকটি মোটরসাইকেলকে এলাকাটি ঘুরতে দেখা গেছে।
পরবর্তীতে দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটের পর মিরপুর-১ নম্বর সনি স্কয়ার (সনি সিনেমা হল) এলাকায় শতাব্দী পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন এসে বাসটির দিকে কিছু নিক্ষেপ করে দ্রুত পালিয়ে যায়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে, আশপাশের মানুষজন দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায় এবং দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।
এ ঘটনায় স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি হঠাৎ এসে শতাব্দী পরিবহন নামে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের মানুষজন আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করে। এ সময় এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং আশপাশের দোকানপাট সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনার খবর পেয়ে শাহ আলী থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
আরও পড়ুন: থানার সামনে পুলিশের গাড়িতে আগুন, যে ব্যাখ্যা দিল ডিএমপি
তবে ডিএমপি শাহ আলী থানার এসআই রুহুল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের টিম ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছি। আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি বাসের পিছনে থাকা যাত্রীদের সিগারেট থেকে এ আগুন লেগেছে।
এদিকে ঢাকা জুড়ে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন আগামীকাল (১৩ নভেম্বর) নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ তাদের “ঢাকা লকডাউন” কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে। দলটি ‘ইউনুস সরকার’ এবং ‘প্রহসনের বিচারের প্রতিবাদে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। একই দিনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণার তারিখ জানাবে। ২০২৪ সালের দমন অভিযানে ১,৪০০ মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অভিযুক্ত। বর্তমানে হাসিনা ভারতে নির্বাসিত অবস্থায় রয়েছেন।
গত এক সপ্তাহে আওয়ামী লীগের অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মীকে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ডিএমপি কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী আদালত এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং বিমানবন্দর সড়ক, মিরপুর রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়েছেন। বিজিবির ১৪টি প্লাটুন ঢাকায় মোতায়েন করা হয়েছে।
ডিএমপির এসএন নাজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বোমা হামলা ও ভুয়া খবরের বিষয়ে কড়া নজরদারিতে আছি।’ অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত ও ছাত্র সংগঠনগুলো জানিয়েছে, তারা যেকোনো ‘লকডাউন’ প্রতিহত করবে।
গৃহ উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই, সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।’ তবে নভেম্বরের শুরু থেকে অন্তত ১৭টি ককটেল হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শাখায় হামলাও রয়েছে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, যারা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে তাদেরকে আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করে অপতৎপরতা দমন করা হবে। তিনি বলেন, রাজধানীতে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারীদের পাশাপাশি তাদের নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আজকেও প্রায় অর্ধশত নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।