শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন লাগার পর ২৭ ঘণ্টায় যা যা ঘটেছিল

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগুন
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগুন  © সংগৃহীত

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রায় ২৭ ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বলেছে। আগুন নেভাতে কাজ করতে হয়েছে ৩৭টি ইউনিটকে। ভয়াবহ এই আগুনের কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল বা অন্য বিমানবন্দরে অবতরণও করাতে হয়েছে। শনিবার বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে লাগা আগুনে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ আমদানিকারকদের পণ্য সামগ্রীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

বিমানবন্দরের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই আগুন এত ছড়িয়ে পড়লো কীভাবে, কিংবা নেভাতেও বা এত সময় কেন প্রয়োজন হলো সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা। এ নিয়ে ফায়ার সার্ভিস, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং বা সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের সাথেও বিবিসি বাংলা কথা বলেছে।

ঢাকার কুর্মিটোলা ও উত্তরা ফায়ার স্টেশনের দমকল বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছে, আগুনের খবর পাওয়ার পর মাত্র ২০মিনিটের ব্যবধানে দুই স্টেশনের দমকল কর্মীরা সেখানে পৌঁছেছিল। কিন্তু শুরুতেই ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি নির্বাপণ টিম সেখানে ঢুকতে পারেনি বলেও সেখানে উপস্থিত ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের কেউ কেউ এমন অভিযোগও করেছে।

যদিও রবিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বেসরকারি বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন দাবি করেছেন–– আগুনের সূত্রপাতের পর মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই অগ্নি নির্বাপণের কাজ শুরু হয়।

আগুনের ঘটনা ঘটার পর প্রায় ওই ২৭ ঘণ্টায় বিমানবন্দর এলাকায় কী কী তৎপরতা ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হলো সেই টাইমলাইন জানারও চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা।

দুপুর আড়াইটায় খবর পায় ফায়ার সার্ভিস

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের পণ্য রাখার কার্গো ভিলেজের অবস্থান বিমানবন্দর পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানে আসা আমদানিকৃত পণ্য রাখা হয় এই কার্গো ভিলেজে।

শুক্র ও শনিবার সাধারণত আমদানিকৃত পণ্য বিমানবন্দর থেকে খালাস হয় না। তবে শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিঅ্যান্ডএফ‘র কর্মীরা সেখানে পণ্যের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সসহ দাপ্তরিক কাজকর্ম করে থাকেন।

সিঅ্যান্ডএফ এর কর্মী তারিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনিও শনিবার দুপুর একটা পর্যন্ত কার্গো ভিলেজের ওই ভবনে ছিলেন। দুপুর একটার দিকে তিনি সেখান থেকে বের হয়ে যান।

ওই সময় সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা জানান, বেলা আড়াইটার দিকে হঠাৎ বিমানবন্দরের ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রচুর ধোঁয়া বের হতে থাকে।

সেখানে উপস্থিত অনেকেই ভিডিও করেন। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তখনই খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসে।

এরই মধ্যে আশপাশে থাকা উৎসুক জনতার অনেকেই সেখানে ভিড় করতে শুরু করে। তখন বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের অনেকেই ওই কার্গো ভিলেজের কাছে যান অগ্নি নির্বাপণ কাজে যোগ দিতে।

দুইটা ৫০ মিনিটে ঘটনাস্থলে আসে ফায়ার সার্ভিস

ওই কার্গো ভিলেজের ঠিক পাশেই বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট যেটি ‘হ্যাঙ্গার গেট‘ নামেই পরিচিত। বিমানে আমদানি হওয়া পণ্য খালাস ওই গেট দিয়েই।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, দুপুর আড়াইটায় তারা বিমানবন্দরের আগুন লাগার খবর পায়। তাৎক্ষণিকভাবে উত্তরা ও কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশন থেকে টিম রওনা দেয়।

উত্তরা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. আলম হোসেন জানান, দুপুর দুইটা ৫০ মিনিটের দিকে প্রথম কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের দমকল বাহিনী ও এর ঠিক কয়েক মিনিটের মধ্যেই উত্তরা স্টেশনের টিমও পৌঁছায় বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটে।

তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য রায়হান শরীফ। গার্মেন্টস পণ্যসহ পঞ্চাশটিরও বেশি পণ্য ছাড়ের দায়িত্ব ছিল তাদের প্রতিষ্ঠানের। যার বেশিরভাগই ছিল ওই কার্গো ভিলেজে। সে সব পণ্যের প্রায় সবই পুড়েছে ভয়াবহ আগুনে।

রায়হান শরীফ বলছিলেন, ’আমি যখন এই গেটের কাছে আসি তখন ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিটও পৌঁছায়। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম- অনুমতি নিয়ে জটিলতার কারণে ফায়ার ফাইটার ও গাড়িগুলো সেখানে ঢুকতে পারছিলো না’।

শনিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করতে দেখা যায় কার্গো ভিলেজে কর্মরত কোনো কোনো কর্মকর্তাকে।

তবে রবিবার বিকেলে আগুন পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন, তখন এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও আগুনের ঘটনার দিন সেখানে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

সোয়া তিনটায় কাজ শুরু

বিকেল সোয়া তিনটার দিকে সেখানে একে একে প্রবেশ করে ফায়ার সার্ভিসের আরও কতগুলো ইউনিট। বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ সেখানে পৌঁছে আগুনে নেভানোর কাজে যোগ দেয় অন্তত ৯টি ইউনিট।

সে সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিটও।

এরপর আস্তে আস্তে বাড়ানো হয় বিকেল পৌনে চারটায় পর্যন্ত আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয় দমকল বাহিনীর অন্তত ২০টি ইউনিট।

কিন্তু ততক্ষণে আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ঢাকার বিভিন্ন ফায়ার স্টেশন থেকে রওনা দেয় দমকল বাহিনীর বেশ কয়েকটি টিম। বিকেল চারটা নাগাদ একযোগে কাজ শুরু করে ফায়ারের ২৫টি ইউনিট। এরপর একে একে আরো বাড়ানো হয় দমকলকর্মীর সংখ্যা।

তখন সেখানে ভিড় বাড়তে শুরু করে উৎসুক জনতার। উৎসুক জনতার ভিড় ঠেকাতে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলা হয়।

ভেতরে যখন আগুন নেভানোর কাজে একে একে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো, তখন বাইরে উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে দেখা যায় বিজিবিকে।

পৌনে চারটায় বিমান ওঠা-নামা সাময়িক বন্ধ
দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে কার্গো ভিলেজের আগুন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে কালো ধোঁয়া।

বিমানবন্দরের যে জায়গায় কার্গো ভিলেজ তার ঠিক কাছেই ছিল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বা এটিসি রুম। যেখান থেকে বিমান চলাচল নিরাপদ ও সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর শনিবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিকেল পৌনে চারটার দিকে ২৬৭ জন যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট কুয়েতের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। যাত্রী, কেবিন ক্রু ও পাইলটরাও বিমানে উঠে বসেছিলেন। আগুনের কারণে ফ্লাইট ছাড়ার আগমুহূর্তে যাত্রীসহ সবাইকে নামিয়ে আনা হয়।

বিকেল পর্যন্ত ৯টি ফ্লাইট ঢাকার পরিবর্তে চট্টগ্রাম শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ ছাড়া একাধিক ফ্লাইট আকাশ থেকেই দেশ-বিদেশের অন্য বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পাঠানো হয়।

ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের কথা থাকলেও আন্তর্জাতিক কয়েকটি রুটের বিমান পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ফেরত পাঠানো হয়। কোনটি আবার অবতরণ করানো হয় কলকাতা বিমানবন্দরে।

যে সব বিমান বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল এমন ফ্লাইটগুলোর শিডিউল আগুনের কারণে পিছিয়ে দেওয়া হয়।

শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বন্ধ হয়ে যায় অভ্যন্তরীণ রুটের বিমান চলাচল।

সন্ধ্যা ছয়টায় যোগ দেয় ৩৭টি ইউনিট

দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় যত গড়াচ্ছিল আগুন ততো ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ ১৩টি স্টেশনের অন্তত ৩৭টি ইউনিট একটানা চেষ্টা করে আগুন নেভানোর।

অগ্নি নির্বাপণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও করা হয়।

আগুনের ভেতর কাজ করতে গিয়ে আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মী আহত কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের ভর্তি করানো হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।

ওই সময়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায় ছোট যে জায়গাটি থেকে আগুনের সূত্রপাত সেটি আরো ছড়িয়ে পড়ে।

ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ ইউনিটের পাশাপাশি বিমান ও নৌবাহিনীর ইউনিটগুলো প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে অগ্নি নির্বাপণের চেষ্টা করে।

৯টা ১৮ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন
ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীর চেষ্টায় প্রায় সাত ঘণ্টা পর রাত নয়টা ৯টা ১৮ মিনিট নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়। দুবাই থেকে আসা ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইট রাত ৯টা ৬ মিনিটে অবতরণ করে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রাত সোয়া ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মুহাম্মদ জাহেদ কামাল কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

এসময় তিনি জানান, আগুন নেভাতে এসে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বাতাস। সেখানে খোলা জায়গায় প্রচুর বাতাস ছিল যেটি আগুনকে জ্বালাতে সহায়তা করেছে।

রবিবার ৪টা ৫৫ মিনিটে সম্পূর্ণ নির্বাপণ
শনিবার রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও সেটি পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগে আরো প্রায় ২০ ঘণ্টা।

শনিবার রাত থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একদিকে যখন আগুন নির্বাপণের কাজ চলছিল, তখন একই সাথে বিমান ওঠানামাও করছিল।

রবিবার বিকেলে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে পরিপূর্ণভাবে নিভেছে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস।

তখন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফিং করে আগুন নির্বাপণ অভিযান সমাপ্তি ঘোষণা করেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।

ব্রিফিংয়ে মি. চৌধুরী জানান, কার্গো ভিলেজের যেখান থেকে আগুনের ঘটনা ঘটেছে সেখানে যদি অগ্নি সতর্কতার (ফায়ার ডিটেকটেড সিস্টেম) থাকতো তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। যে কারণে আগুন নেভাতেও বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।

আগুনের সূত্রপাত কীভাবে কিংবা এটি এতটা ছড়ালো কীভাবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক বলেন, ’সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে সেটা আমরা দেখছি। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। নির্বাপণের পরই সাধারণত প্রাথমিক রিপোর্ট দেওয়া হয়। তারপরই তদন্ত কমিটি হয়। এটার জন্য আমাদের একটু সময় দিতে হবে। যাচাই বাছাই ও তদন্ত করে বলতে পারবো আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে’।

এই আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সেই কমিটি কাজ শুরু করেছে।


সর্বশেষ সংবাদ