শক্তিমত্তার জানান দিচ্ছে কেএনএফ, পার্বত্য তিন জেলা ফের অশান্ত
- শহিদুল ইসলাম সাহেদ
- প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২৭ PM , আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২৭ PM
পাহাড়ে নতুন আতঙ্কের নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। এটি কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) একটি সামরিক শাখা। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সন্ত্রাসী তৎপরতা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলাই প্রমাণ করে কেএনএফের শক্তিমত্তা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। গত দু-তিন বছর ধরেই বান্দরবান এলাকায় কেএনএফের তৎপরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা অর্থ রোজগারের একটা পথ বেছে নিয়েছিল।
জানা যায়, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সবচেয়ে এগিয়ে বান্দরবান। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আড়ালে এ অঞ্চলে আনাগোনা বেশি বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর। যার কারণে পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে অস্থিরতায়ও সবচেয়ে এগিয়ে এ জেলা। বান্দরবানের এই অস্থিরতার সঙ্গে সম্প্রতি যে গোষ্ঠীর নাম সবার আগে আসছে সেটি হলো কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। বাংলাদেশের সরকার তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
তথ্যমতে, কুকি-চিনের সন্ত্রাসীরা বান্দরবানে মেতে উঠেছে রক্তের খেলায়। কেএনএফ-এর সামরিক শাখা কেএনএ-এর শতাধিক সদস্য তিন বছর আগে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে যায়। অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বান্দরবানের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করছে তারা। গত ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। এই দলের সদস্যরাই এখন সেনাবাহিনীর ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়ে প্রায় সাত বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সারোয়ার। তিনি জানান, কেএনএফ-এর নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যেমন হত্যা, চাঁদাবাজি, জোরপূর্বক খাদ্য সংগ্রহ, ডাকাতি, নির্যাতন ও এলাকা অশান্ত হওয়ায় বম জনগোষ্ঠী ও বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কিছুটা বিভক্তি তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্র বলছে, গত কয়েক মাসে কেএনএফ বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়েছে। তারা গত ১১ মার্চ থানচি থেকে ১২ জন নির্মাণশ্রমিককে অপহরণ করে। এর মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন কেএনএফের গুলিতে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন মারা যান এবং দুই সেনাসদস্য আহত হন। ১৫ মার্চ রুমার লংথাসি ঝিরি এলাকা থেকে কেএনএফ সদস্যরা অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আনোয়ারসহ ৯ জনকে ধরে নিয়ে যায়। কেএনএফ আতঙ্কে বম সম্প্রদায়ের অনেক পরিবার নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িতে চলাচল করা পরিবহনের মালিকদের যৌথ বাহিনীর অভিযানে গাড়ি না পাঠাতে হুমকি দেয় সংগঠনটি। এরপর গাড়িচালকদের ওপর গুলিবর্ষণ ও একাধিক দফায় অপহরণের ঘটনা ঘটে। কেএনএফের এসব কর্মকাণ্ডে পাহাড়ে পর্যটনশিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মাঝে মাঝে এ সংগঠনের সদস্যরা সাধারণ বম পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করছে। তাদের গৃহস্থালির জিনিসপত্র লুট করে নিচ্ছে তারা।
বান্দরবানের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের কারণে পাহাড়ে থমকে আছে উন্নয়ন কাজ। এছাড়া এদের কারণে পাহাড়ে বন্ধ রয়েছে পর্যটকদের আসা-যাওয়া। সব মিলিয়ে কুকি-চিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে থমকে আছে বান্দরবানের জনজীবন।
কুকি-চিনের অত্যাচারের কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ পাহাড়ি তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে বান্দরবান সদর উপজেলার আশ্রয় শিবিরে উঠেছেন। কুকি-চিনরা বম সম্প্রদায়ের। কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের ছাড়ছে না তারা। কুকি-চিন শুধু নিজেরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে তাই নয়, জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে তারা।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ (অব.) বলেন, পাহাড়ের এই সংঘাতের কারণ কেএনএফের সঙ্গে অন্য সশস্ত্র সংগঠনের আধিপত্যের লড়াই। যারা যত বেশি জায়গা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে তত বেশি চাঁদার ভাগ পাবে তারা। কেএনএফ পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। জঙ্গিদের সঙ্গেও তাদের আঁতাত রয়েছে। খুব অল্পসংখ্যক নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী কেএনএফ যাতে পাহাড়ে কোনোভাবে সুসংহত অবস্থান তৈরি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মেহ্লাঅং মারমা বলেন, কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের কারণে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ অনেক অশান্তিতে আছে। পাহাড়ের সাধারণ মানুষের সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই সন্ত্রাসীরা। কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি এবং মানুষজনকে জিম্মি করার কারণে পাহাড়ে কোনো ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম বর্তমানে করা যাচ্ছে না। কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের কারণে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে মানুষজন বসবাস করতে পারছে না। তারা পাহাড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষকে জিম্মি-অপহরণের পাশাপাশি নিয়মিত চাঁদা দাবি করছে অহরহ। তাদের কথা যারা শুনছে না বা তাদের যারা চাঁদা দিচ্ছে না তাদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষ শহরের দিকে চলে যাচ্ছে।