‘তুমি কেমন বাবা, নিজের সন্তানকে একটু জড়িয়ে ধরতেও পারো না’
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৫, ১১:৪৯ AM , আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২৫, ১২:৪৭ PM
‘হাসপাতালের বিছানায় ছেলের কাছে গিয়ে যখন বসি, ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে- তুমি কেমন বাবা যে, নিজের সন্তানকে একটু জড়িয়ে ধরতেও পারো না। পোড়া শরীর, আমরা ছেলে একটা হাতই নাড়াতে পারে, ওই হাতটিই ওপরে তুলে মোনাজাত ধরে, অহস্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়’।
রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বসে কথা বলছিলেন মিজানুর রহমান। এ সময় সন্তানের চিকিৎসার বিষয়ে আলাপ করার সময় ভেঙে পড়েন, আর কিছুই বলতে পারেননি তিনি। তার ছেলে নাভিদ নাওয়াজ দীপ্ত উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
গত ২১ জুলাই মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় শরীরের ৫২ শতাংশ পুড়ে গেছে দীপ্তর। সেদিন থেকে একমাস জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে দীপ্ত। সেই সঙ্গে সাথে তার পরিবারও। দীপ্তর বাবা বলছিলেন, ‘এভরি মোমেন্ট ইজ এ নিউ মোমেন্ট ফর আস। সব কিছু ছেড়ে এ একটা মাস, আমি আর আমার স্ত্রী- এ হাসপাতালেই থাকি, ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়ি, এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’
মাইলস্টোনের বিমান দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত যে ৩৫ জন নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ২৭ জনই শিক্ষার্থী। দীপ্তসহ ২৩ জন ভর্তি রয়েছেন ঢাকার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে। আরেকজন ভর্তি আছেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। দুর্ঘটনার এক মাস পর দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন ক্যাম্পাস একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সপ্তাহ খানেক হলো স্কুল শাখার শ্রেণীকক্ষে পাঠদানও শুরু হয়েছে।
বিধ্বস্ত ও পুড়ে যাওয়া সেই হায়দার আলী ভবনটি শুধু্ই বয়ে বেড়াচ্ছে ক্ষত চিহ্ন। শিক্ষক-অভিভাবকরা বলছেন, পাঠদান শুরু হলেও এখনো আতঙ্ক পুরোপুরি কাটছে না শিক্ষার্থীদের। যে কারণে স্কুলে শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি ফেরাতে কাউন্সিলিংসহ নানা কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। একমাস পূর্তির দিন ২১ শে অগাস্ট স্কুলটিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, কারো কারো মধ্যে এতটাই আতঙ্ক রয়েছে যে, অনেকে নিয়মিত স্কুলে আসছে না। এরই মধ্যে তদন্ত কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত তদন্ত কমিশন। কমিটির সদস্য অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে আমরা বিভিন্ন ধরনের সংস্থার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছি। বিভিন্ন পক্ষ আমাদের নানা ধরনের তথ্য দিচ্ছে। সব কিছু শেষে আমরা তদন্ত রিপোর্ট জমা দেব।’
মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় যারা আহত হয়ে ঢাকার জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে ভর্তি রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগের শরীরই আগুনে পুড়ে গেছে। কারো কারো অর্ধেকেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে আগুনে। শরীরে অর্ধেকেরও বেশি পোড়া নিয়ে এই হাসপাতালে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র নাভিদ নাওয়াজ দীপ্তর যুদ্ধটা ঠিক এক মাস ধরেই চলছে। একমাস হাসপাতালের আইসিইউতে ছেলেকে রেখে কোথাও যেতে পারছেন না বাবা মিজানুর রহমান।
দীপ্তর বাবা বলছিলেন, ‘এ সময়ের মধ্যে প্রতিটা মুহূর্ত একটা নতুন অভিজ্ঞতা। ডাক্তারও বলতে পারছে না ছেলে আমার ভালোর দিকে যাচ্ছে, না খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডাক্তাররা শুধু বলে আপনারা আল্লাহকে ডাকেন।’
ওইদিন কিভাবে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল দীপ্তর, তা বলছিলেন তিনি। তার ভাষ্য, ওইদিন বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় নিরাপদেই ছিলেন দীপ্ত। কিন্তু সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় দীপ্ত দেখে একই ক্লাসের তার কয়েক বন্ধু আগুনে আটকা পড়ে গেছে। তাদেরকে সাহায্য করতে গিয়ে যে সময়টুকু লাগে তাতে দীপ্তর শরীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
‘এমনভাবে পুড়েছে যে দীপ্তর গায়ে কোনো কাপড়- চোপড় ছিল না। তখন আনোয়ার নামের একজন টিচার তাকে বের হওয়ার জন্য জোর করলে তখন সে বলল না আমার বন্ধুদের বের না করে যাবে না। পরে ওই শিক্ষক তার গায়ের শার্ট খুলে তাতে দীপ্তকে পেঁচিয়ে সেখান থেকে বের করে’, বলছিলেন তিনি।
দীপ্তর ছোট বোন নাইরা আফরিনও পড়তেন একই স্কুলের ক্লাস ফোরে। সেদিন অন্য ভবনে ক্লাসে ছিল নাইরা আফরিনের। যে কারণে নাইরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছেন। দীপ্ত এখনো পোড়া শরীর নিয়ে বেঁচে ফেরার যুদ্ধ করলেও, একই ক্লাসের আটজন শিক্ষার্থী মারা গেছেন এ বিমান দুর্ঘটনায়। আর আহতের অনেকে এই বার্ন ইন্সটিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
২১ জুলাই দুর্ঘটনার দুই সপ্তাহ পর গত ছয়ই অগাস্ট থেকে পাঠদান শুরু হয় কলেজ শাখার। আর ১১ অগাস্ট থেকে ক্লাস শুরু হয় স্কুল শাখার। এরপর ক্লাসে ফিরতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। তবে অনেক ক্লাসে সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ক্লাস সেভেনের ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থী সূর্য সময় বিশ্বাস। বিমান দুর্ঘটনার পর বন্ধুদের অনেককে নিরাপদে বের করার কারণে দুর্ঘটনার পর সূর্যকে নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়।
এক সপ্তাহ হয়েছে স্কুলে যাচ্ছে সূর্য। তার মা শারমিন ইসলাম সাথী একই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় আমার ছেলে যখন দোতলায় ছিল, তখন সে জানেই না যে আগুন কতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। ও ভেবেছে অল্প জায়গায়। তখন নিরাপদে বের হতে পারলেও এখন সে ভিডিও দেখে বুঝতে পারছে আসলে কী হয়েছিল।’
তিনি জানান, এক সপ্তাহ থেকে সূর্য ক্লাসে তার বন্ধুদের সাথে সেই দুর্ঘটনার সময়ের নানা কিছু নিয়ে গল্প করছে। ওই ক্লাসের আটজন মারা গেছে, বাকি যারা বেঁচে ফিরেছে, তারা একেকজন নিজেদের মধ্যে বেঁচে ফেরার গল্প করছে।
স্কুলটির শিক্ষকরা বলছেন, এখনো অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। যে কারণে সপ্তাহ খানেক ধরে স্কুল শাখার ক্লাস চালু হলেও কেউ কেউ সাহস করে আসছে না। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুরা এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. শাহানা পারভিন বলেন, ‘অনেক অভিভাবক ওই পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা করা যাবে না। ট্রমাটা রিকল করে আস্তে ভয়টা কাটাতে হবে।’
গত এক মাসে ঠিক এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সূর্যও। তার আচরণেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন তার মা। তিনি বলেন, ‘আগে সূর্য রান্নাঘরে যেতো, ডিম ভাজি-নুডুলস এগুলো করতে পারতো। এখন আগুনের কাছে যেতে তার মধ্যে দ্বিধা কাজ করে। আগুন দেখলে তার মধ্যে ভীতি কাজ করে।’
উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে ভবনটিতে আঁছড়ে পড়েছিল বিমানটি, সেটির নাম হায়দার আলী ভবন। বিমান দুর্ঘটনায় এত প্রাণহানির পর দোতলা ওই ভবনটি আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। সেটি চারদিক থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে। ওই ভবনে যে সব ক্লাস হতো, তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্য ভবনে।
দুর্ঘটনার এক মাস পূর্তিতে বৃহস্পতিবার স্কুলটিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার। দুর্ঘটনার প্রায় ১৫ দিন পরে দুই ধাপে কলেজ ও স্কুল শাখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে ছাত্র- ছাত্রীদের মানসিক কাউন্সিলিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, স্কুল খোলার আগে অভিভাবকদের সাথে কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন তারা। চিকিৎসা ক্যাম্প খোলা হয়েছে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে। সেখানে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনা: চালক ওয়াশরুমে, গাড়ি নিয়ে ‘পালাচ্ছিলেন’ আরোহীরা!
স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষিকা বলেন, ‘এটা ছোট কোনো ঘটনা নয় যে এত দ্রুত আমরা স্বাভাবিক হতে পারবো। আহত- নিহতদের পরিবারে সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখছি। তারা যাতে ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারে তাদেরকে সে কারণে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে’।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ আট দফা দাবিতে গত শনিবার দিয়া বাড়ির স্কুল ক্যাম্পাসে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে অভিভাবকরা। কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, ঘটনার পর অভিভাবকদের একটি অংশ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হওয়ার পর এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘিরে পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কা করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
প্রধান শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার বলেছেন, ‘অভিভাবকরা তো আসলে তাদের জায়গা থেকে বলতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমার বলার মতো কিছু নেই।’
তদন্তের অগ্রগতি
গত ২১ জুলাই ঘটনার পরদিনই স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মূলত সেই কমিটি ছিল দুর্ঘটনায় আহত নিহতের সংখ্যাসহ বিস্তারিত তথ্যের জন্য। কেননা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি অংশকে প্রচার করতে দেখা গিয়েছিল যে, বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আড়াল করা হচ্ছে।
বুধবার স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত স্কুলটির ২৭ জন শিক্ষার্থী, তিন জন শিক্ষক, তিনজন অভিভাবক ও একজন আয়া নিহত হয়েছে। স্কুলটির প্রাথমিক তদন্তে নিখোঁজের কোনো সংখ্যা পায়নি।
স্কুল সেকশনের প্রধান শিক্ষিকা ও তদন্ত কমিটির সদস্য খাদিজা আক্তার বলেন, ‘আমরা প্রতিটি পরিবার ও শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই রিপোর্ট প্রস্তুত করেছি, এ দুর্ঘটনায় কেউ নিখোঁজ নেই।’
স্কুল কর্তৃপক্ষের বাইরে গত ২৮ জুলাই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি তদন্তে ৯ সদস্যের কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সাবেক সচিব এ কে এম জাফর উল্লা খানকে সভাপতি করে গঠিত কমিশনকে চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, স্কুলটি পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছেন তারা। দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের সংখ্যা জানতে আগামী শনিবার তদন্ত কমিশন স্কুলটির অভিভাবকদের সাথে কথা বলবে। পাশাপাশি তদন্ত কমিশন বিমান বাহিনীর সঙ্গে অফিসিয়ালি কথা বলেছে। বিমান বাহিনী নিজস্ব তদন্ত রিপোর্টও কমিশনকে দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
সব প্রক্রিয়া শেষে কমিশন কী চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে পারবে? এমন প্রশ্নে কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত হয়তো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে পারবেন না তারা।
বিবিসি বাংলা