ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থীকে মারধর

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আটক এক কর্মকর্তা ছিলেন ‘আওয়ামী লীগের ডোনার’

আটকের পর শফিউল আলম (বামে), আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব বড়ুয়ার সঙ্গে শফিউল আলম (ডানে)
আটকের পর শফিউল আলম (বামে), আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব বড়ুয়ার সঙ্গে শফিউল আলম (ডানে)  © টিডিসি সম্পাদিত

রাজধানীতে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা দুই শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে অফিসে মারধরের ঘটনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তাকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে মহাখালীর আমতলী এলাকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সামনের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। বর্তমানে তারা বনানী থানায় আটক রয়েছেন। রাত ৮টার পর বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল সারোয়ার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করে বলেন, তারা এখনও থানায় আছেন। তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো মামলা হয়নি।

জানা গেছে, আটক দুই কর্মকর্তার একজন মোহাম্মদ শফিউল আলম (সাকিব), যিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বন্যাপ্রবণ ও নদী ভাঙন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র প্রকল্পের এপিডি হিসেবে কর্তরত রয়েছেন। শফিউল আলমের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চরম্বা ইউনিয়নের আতিয়ার পাড়ায়। তার বাবার নাম আব্দুল হাকিম। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই কর্মকর্তার আওয়ামী লীগের কোনো পদপদবি না থাকলেও তিনি ছিলেন দলটির অঘোষিত ডোনার। পতিত এ দলটি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সব অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। বিরোধী মতের লোকজনদের কথায় কথায় পুলিশে দেয়ার হুমকি দিতেন তিনি। সখ্যতা ছিল আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া থেকে শুরু করে একাধিক নেতার সঙ্গে।

শুধু তাই নয়, জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রদের বিরুদ্ধে অর্থ সরবরাহকারী, শেখ হাসিনার লোকজনকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে তাদের যোগসাজশে ভুয়া টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লুণ্ঠনকারী এই কর্মকর্তা ২০১১ সালে কক্সবাজারের উখিয়ায় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) হিসাবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। দ্বিতীয় শ্রেণির এই চাকরিতে যোগদানের পর থেকে যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন এই কর্মকর্তা।

এই কর্মকর্তার নিজ ইউনিয়নের ইব্রাহিম হোসেন নামে এক বাসিন্দা জানান, শফিউল আলম যেহেতু সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন তাই আওয়ামী লীগে তার কোনো পদ-পদবী ছিল না। তবে তিনি প্রচুর অর্থকড়ি খরচ করতেন আওয়ামী লীগের পেছনে। তাছাড়া বিরোধী মতের লোকজনদের কথায় কথায় পুলিশে দেয়ার হুমকি দিতেন তিনি। তার ভয়ে তখন সবাই সারাক্ষণ শঙ্কিত থাকতেন। 

লোহাগাড়া উপজেলার মো. হারুন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়েও এলাকায় আসলে আওয়ামী লীগের বড় নেতার মতো চলাফেরা করতেন। তাকে আওয়ামী লীগের সব অনুষ্ঠানে দেখা যেতো। তাছাড়া ফেসবুকে আওয়ামী লীগের বড় নেতার সঙ্গে তার ছবি দেখতাম। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে থাকাকালীন বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে আদালত এই কর্মকর্তাকে জেল হাজতে পাঠান। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামালের ডান হাত হওয়ায় তার প্রভাব খাটিয়ে সমস্ত মামলা থেকে অব্যাহতি নেন। দোষী হয়েও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করেন। তার সমস্ত দুর্নীতির বিষয়ে পুনরায় তদন্ত করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার মত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে তারা মনে করেন। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পর ১৬ আগস্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামালের রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাবর রোডের বাসা থেকে নগদ ৩ কোটির বেশি টাকা এবং ১০ লাখ টাকা মূল্যের বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ দল। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এপিডি শফিউল আলম সাকিবকে তদন্তপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসবে সাবেক সচিব শাহ কামালের গোপন সম্পদের সন্ধান।

এ বিষয়ে জানতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমানকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।

মহাখালীর আমতলী এলাকায় যা ঘটেছিল
সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে মহাখালীর আমতলী এলাকায় ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের দাবি, সড়কের উল্টো পথে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে যাচ্ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা। এক শিক্ষার্থী তাদের ঘুরে যেতে বললে দুই কর্মকর্তা তার ওপর চড়াও হন। এক পর্যায়ে তারা শিক্ষার্থীকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ভবনের নিচে নিয়ে যান। সেখানে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে আরও কয়েকজন মিলে মারধর করেন। পরে এ ঘটনায় ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য ও অন্য শিক্ষার্থীরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে গিয়ে শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন।

এ সময় অন্য শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তার গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর বনানী থানা পুলিশ অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।

পরে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল সারোয়ার বলেন, মহাখালীর আমতলী এলাকায় ট্র্যাফিক বিভাগে সহায়তাকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দুই কর্মকর্তা বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান। এ সময় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সেই দুই কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং মারধর করেছেন। তাই দুই কর্মকর্তাকে আমরা থানায় নিয়ে এসেছি। শিক্ষার্থীরা কোনো অভিযোগ দায়ের করলে সে অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


সর্বশেষ সংবাদ