৮ মাসে ৩৬১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৬৬ জন

আট মাসে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন
আট মাসে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন  © ফাইল ছবি

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সারাদেশে ৩৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এতে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি, ২১৪ জন। আর ছাত্র ছিল ১৪৭ জন। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ঢাকা বিভাগে। শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান: কোন পথে সমাধান?’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করেন ফারজানা আক্তার লাবনী।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা প্রতিরোধে আঁচল ফাউন্ডেশন ১১টি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ে আত্মহত্যা করেছিল ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী। প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ৪৫ দশমিক ১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। যেখানে স্কুল শিক্ষার্থী ১৬৯ জন, কলেজের ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৬ জন এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩০ জন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া খুলনা বিভাগে ১৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪.১০, রংপুরে বিভাগে ৮.৯০, ময়মনসিংহে ১০ শতাংশ, রাজশাহীতে আত্মহত্যা করেছে ১১.৯০ এবং বরিশালে আত্মহত্যা করেছে ৮.৩০ শতাংশ। সিলেটে আত্মহত্যার হার ২.৫ শতাংশ। 

সমীক্ষার তথ্য অনুসারে, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে নারী শিক্ষার্থীরা। ৩৬১ জনের ৫৯.৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছে । অপরদিকে ৪০.৭০ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থী  আত্মহত্যা করেছে। শুধু নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা যায়, ২৬.৬০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী অভিমান, প্রেমঘটিত কারণে ১৮.৭০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮.৪০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদে ৯.৮০ শতাংশ, ৫.১০ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির কারণে এবং পড়াশুনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে ১২.৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। 

আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর ৪৭.৪ শতাংশই ছিল স্কুলগামী। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ছিল ১১২ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৫৮ জন। এছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মাঝে কলেজগামী শিক্ষার্থী ছিল ২৫.৮০ শতাংশ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ১৮.৮০ শতাংশ। আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছে ৮.৩১ শতাংশ।

আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী। ৬৭.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিলেন এ বয়সী। এর মাঝে নারী শিক্ষার্থী ছিল ১৫৯ জন। অন্যদিকে পুরুষ শিক্ষার্থী ৮৪ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২১.৬ শতাংশ। ২৬ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২.৮০ শতাংশ। ১ থেকে ১২ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ৮.৩০ শতাংশ। 

আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক দল শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ৩১.৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মাঝে নারী শিক্ষার্থী ৫৭ জন এবং সম সংখ্যক পুরুষ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এছাড়াও আত্মহত্যা করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছে। যেমন- প্রেমঘটিত, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, একাডেমিক চাপ, মানসিক অস্থিতিশীলতা, পারিবারিক সমস্যা এবং অন্যান্য। 

আরো পড়ুন: চবিতে তাণ্ডব: ক্ষোভ নাকি পূর্ব পরিকল্পিত?

প্রেম ঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৫.৮০ শতাংশ। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৬.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১১.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩.৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। একাডেমিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার কারণে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কম বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সেখানেও দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। গত আট মাসে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩০ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থেকে উত্তরণের পথ বাতলে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ঠেকাতে আমাদের উচিত, তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগী হওয়া। তার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্য এবং শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর দায়িত্বশীল হতে হবে, যেন তারা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নবান হতে পারেন।’ 

অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদা ইয়াসমিন আত্মহত্যার পেছনে বর্তমান প্রজন্মের একাকী থাকাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘এখনকার প্রজন্ম খুব একা থাকতে পছন্দ করে এবং তারা খুব একাকীত্বে ভোগে। তাদের মধ্যে একাকীত্ব থেকে শূন্যতা, শূন্যতা থেকে হতাশা, এবং পরবর্তীতে তারা নিজেদেরকে বোঝা মনে করে। তাদের মধ্যে দেখা যায় পারস্পরিক সম্মান থাকে না। তখনই তারা এ ধরনের আশ্রয় নিতে পারে।

তিনি বলেন, একাকীত্বের সময় হাতের কাছে তখন সাহায্য করার মতো কেউ থাকে না।  তখন যদি আমরা তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি তাহলে। এতে তাকে ওই জায়গা থেকে বের করে আনা যায়।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. শহীদুল ইসলাম আত্মহত্যা প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগের কথা জানিয়ে বলেন, ‘আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রিত অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হিসাবে বিবেচনা করে। আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তাবায়নযোগ্য ৫ম এইচপিএনএসপি সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় সরকার এই প্রথমবারের মতো একটি ডেডিকেটেড অপারেশনাল প্ল্যান ‘মেন্টাল হেলথ এন্ড ডিসএ্যাবিলিটি (এমএইচডি)’ অনুমোদন করতে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এর মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরের মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত আত্মহত্যা ও এর প্রচেষ্টা প্রতিরোধে অত্যাধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হাতে নেয়া হচ্ছে। যার সুফল দেশবাসী অচিরেই পাবে। 


সর্বশেষ সংবাদ