স্বাস্থ্যঝুঁকি চরমে
ঝালকাঠিতে সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে চলছে অবৈধ ইটভাটা
- মো. নাঈম হাসান ঈমন, ঝালকাঠি
- প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৫ PM
ঝালকাঠি জেলাজুড়ে সরকারি বিধিবিধান অমান্য করে ব্যাপকহারে গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট করে, বনভূমি উজাড় করে, নদীর তীরের মাটি কাটার মাধ্যমে পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এসব ভাটা। গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর কালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বিদ্যালয়ের শিশুরা ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ইটভাটা রয়েছে মোট ৪২টি। এর মধ্যে বৈধ মাত্র ১৯টি, আর বাকি ২২টি ইটভাটা সম্পূর্ণ অবৈধ। এসবি-১ এবং ২, জিজিবি, এসসি, এমসিবি, সেভেন স্টারসহ অধিকাংশ ভাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একদম পাশে স্থাপিত। আইন অনুযায়ী বিদ্যালয়–আবাসিক এলাকা—কোনোটির কাছেই ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে চলছে ঠিক উল্টো চিত্র।
ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার রঘুয়ারদড়িচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই পরিচালিত হচ্ছে এসবি নামের দুটি ইটভাটা। এখানে প্রকাশ্যেই পোড়ানো হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাঠ। ভাটার নির্গত কালো ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা, অ্যালার্জিসহ নানা সমস্যায় পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরা বলছেন, ক্লাস করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ধোঁয়া সহ্য করতে হচ্ছে। শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা চরম উদ্বিগ্ন।
অবৈধ ভাটাগুলোতে কাঁচামাল হিসেবে নির্বিচারে কেটে নেওয়া হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর মাটি ও নদীর তীর। এতে জমির প্রাকৃতিক উর্বরতা নষ্ট হয়ে বছরে বছরে কমছে ফসল উৎপাদন। কৃষকেরা বলছেন, এক সময় যে জমিতে বছরে দুই–তিন ফসল হতো, এখন সেসব জমি হয়ে পড়ছে অনুর্বর ও শক্ত।
ইট প্রস্তুতকারী আইন অনুযায়ী ভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ ঝালকাঠির অধিকাংশ অবৈধ ভাটায় প্রকাশ্যেই জঙ্গলের কাঠ ব্যবহার করে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এতে একদিকে বনভূমি উজাড়ের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে ধোঁয়া বায়ুদূষণকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভাটার চারপাশে পানি না ছিটানোয় বাতাসে সারাক্ষণ ধুলা উড়ছে, যা শ্বাসতন্ত্রের গুরুতর ক্ষতি করছে।
পরিবেশ বাদী সংগঠন নিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ঝালকাঠি জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আককাস সিকদার বলেন, ঝালকাঠি সদরসহ চার উপজেলায় শতাধিক বৈধ ও অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটা স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করে অথবা তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এতে বন উজাড় হচ্ছে পাশাপাশি এথেকে সৃষ্টি হওয়া কালো ধোঁয়ায় স্কুল কলেজের কোমলমতি শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
গ্রামীণ সড়কের পাশে গড়ে ওঠা এসব ভাটায় দিনরাত ট্রলি ও ট্রাকে ইট পরিবহন করা হয়। রাস্তা ঢেকে পরিবহন না করায় ধুলা দূষণ বাড়ছে; ভারী যানবাহনের চাপ দ্রুত নষ্ট করছে এলজিইডির গ্রামীণ সড়ক। স্থানীয়দের মতে, রাস্তা মেরামতের আগেই ফের নষ্ট হয়ে যায় ট্রলি-ট্রাকের চাপে।
অবৈধ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে ভাটার মালিকরা কথা বলতে রাজি হন না; বরং এনটিসি, এসবি, এমসিবি, সেভেন স্টারসহ একাধিক ইটভাটার কর্তৃপক্ষ সংবাদকর্মীদের সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেন, যা সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো. মমিন উদ্দিন বলেন, ‘জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরকে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালানো হবে। ’
ঝালকাঠি জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আনজুমান নেছা বলেন, তারা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে কাঁচা ইট ধ্বংস ও জরিমানা করেন।অভিযানের পর কয়ে কদিন বন্ধ থাকে, পরে আবারও আগের মতোই ভাটা চালু হয়ে যায়।