চলনবিলে মাঠে মাঠে ‘বিনা হালে রসুন’ আবাদে ব্যস্ত চাষিরা
- এম এস রহমান, পাবনা
- প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩০ PM
চলনবিলজুড়ে এখন রসুন রোপণের ব্যস্ত মৌসুম। আমণ ধান ঘরে তোলার পর থেকেই পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জের বিস্তীর্ণ বিলাঞ্চলে কৃষকরা নেমে পড়েছেন ‘বিনা হালে রসুন’ আবাদের কাজে। কম খরচে বেশি ফলন পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত রসুন, যা স্থানীয়দের কাছে ‘সাদা সোনা’ নামেই বেশি জনপ্রিয়। ভোরের কুয়াশা মাথায় নিয়ে নারী-পুরুষ শ্রমিক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও রোজ মাঠে মাঠে রসুনের কোয়া বুনে চলেছেন। তবে আবাদে উৎসাহ থাকলেও বাজারদর কমে যাওয়ায় চাষিদের মনে রয়েছে শঙ্কা।
প্রতিবছরের মতো এবারেও এই এলাকার কৃষকরা রসুন রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে এই রসুন আবাদে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি হলেও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। কুয়াশাঘেরা ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠের পর মাঠ রসুনের কোয়া রোপণ করে যাচ্ছেন কৃষকরা। পুরুষ ও নারী শ্রমিকের পাশাপাশি স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত দরিদ্র শিক্ষার্থীরাও মজুরির ভিত্তিতে রসুন রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
চলনবিল অঞ্চলের পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়ার পশ্চিমাংশসহ বিভিন্ন এলাকায় দুই দশকের অধিক সময় ধরে রসুনের আবাদ করে আসছেন কৃষকরা। খরচ কম ও অধিক দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফলন বেশি পাওয়ায় এই এলাকার কৃষকদের কাছে অধিক জনপ্রিয় রসুনের আবাদ। তবে চলতি বছরে রসুনের দাম বাজারে কম হওয়ার কারণে কিছুটা শঙ্কিত রসুন চাষিরা।
সরেজমিন চাটমোহর উপজেলার খলিসাগাড়ি, বোয়াইলমারী, ধানকুনিয়া, চিনাভাতকুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত নারী-পুরুষ বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সারিবদ্ধভাবে বসে রসুনের কোয়া রোপণ করে যাচ্ছেন। এরপরেই রোপণকৃত কোয়ার ওপর খড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। ছিটানো হচ্ছে সার, দেওয়া হচ্ছে কীটনাশক। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কয়েক মাস পরেই রসুন ঘরে তুলবেন এই এলাকার কৃষকরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে রসুনের আবাদ করে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ধানের ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন এই অঞ্চলের কৃষকরা।
তবে কৃষকদের পাশপাশি প্রতিবছর এই অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকরাও অনেকটাই লাভবান হয়ে থাকে। এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত রসুনের বীজ রোপণে ব্যস্ত সময় পার করতে থাকা শ্রমিকদেরও চাহিদা থাকে অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। এতে করে তাদেরও আর্থিক স্বচ্ছলতা দেখা দেয়। একজন পুরুষ শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে ৬০০-৭০০ টাকা দিন হাজিরা পেয়ে থাকেন। কিন্তু একই কাজ করে একজন নারী শ্রমিক পেয়ে থাকেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরি।
জানা গেছে, প্রতি বিঘা জমিতে রসুন উৎপাদন হয় ৩০ থেকে ৩৫ মণ। প্রতি বিঘা রসুন চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। বাজারে রসুনের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলে প্রতি বিঘা থেকে প্রাপ্ত রসুন বিক্রি হয় লাখ টাকার কাছাকাছি। তবে বর্তমানে রসুনের বাজার দর নিম্নমুখী হওয়ার কারণে দাম পাওয়া নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত রসুন চাষিরা। কৃষি অফিসের জরিপ অনুযায়ী চলতি মৌসুমে পাবনার চাটমোহর উপজেলায় ৪ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৪৭ হাজার ৯১৫ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাজারদর ঠিকঠাক থাকলে এই এলাকার কৃষকরা লাভবান হবেন বলে উপজেলা কৃষি অফিস।
ফরহাদ নাসিম নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমি প্রায় ২০ বিঘা জমিতে রসুন চাষ করছি। রসুন চাষে কোনো ঝুঁকি নেই এবং কম খরচে অধিক ফলন পাওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই রসুনের আবাদ করে আসছি। তবে এ বছর রসুনের বাজারদর কম থাকায় কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে।’
আব্দুর রহিম নামের অপর এক কৃষক বলেন, “আমি ৩ বিঘা জমিতে রসুন চাষ করছি। একসময় দিনমজুরি করে সংসার চালাতাম। কিন্তু জমি লিজ নিয়ে রসুন চাষ করেই জমি কিনেছি। অন্য ফসল চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমাদের এলাকার অনেক মানুষ-ই রসুন চাষ করে দরিদ্রতা দূর করেছেন। যে কারণে চলনবিল এলাকায় রসুন ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত।”
খলিসাগাড়ি বিলে কাজ করা কয়েকজন নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই সময় গ্রামের বাড়িতে তেমন কোনো কাজ থাকে না। আমরা বাড়ির পাশে বিলে রসুন বোনোর কাজ করে কিছু টাকা আয় করতে পারি। কারণ পরিবারের একজনের আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পাই। তাতে করে বেশ কিছুদিন কাজ করলে বাড়তি আয় হয়। আবার রসুন জমি থেকে তোলার পর আমাদেরই বাছাইয়ের জন্য কাজ দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে এমন চাষ পদ্ধতি আমাদের ভালো একটা আয়ের উৎস।’
চাটমোহর উপজেলা কৃষি অফিসার কুন্তলা ঘোষ বলেন, ‘রসুন চাষ চলনবিল এলাকার মানুষের কাছে প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রিয়। উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পরামর্শ থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। আশা করি অন্য বছরের মতো এবারেও রসুন চাষে লাভবান হবেন এই এলাকার কৃষক।’