বিদেশিদের হাতে এনসিটি গেলে বাড়বে রাজনৈতিক চাপ

চট্টগ্রাম বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দর  © সংগৃহীত

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে–বাইরে প্রতিদিনই চলছে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি। বিষয়টি এখন শুধু বন্দর-কেন্দ্রিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই; ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় রাজনীতিতেও। অভিজ্ঞ মহল বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তবে এনসিটি নিয়ে অস্থিরতা আরও বাড়বে।

দেশের সবচেয়ে আধুনিক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং স্থাপনাগুলোর একটি এনসিটি। এখানে প্রতিদিন কাজ করেন দেশের হাজারো শ্রমিক-কর্মচারী। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে গত ১৭ বছর ধরে এটি পরিচালনা করছে একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দরে মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানো-নামানো হয় এই টার্মিনাল দিয়ে। ২০০৭ সালে যেখানে একটি জাহাজের গড় অবস্থানকাল ছিল ১০-১২ দিন, বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র দুই আড়াই দিনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরচ বাদে এনসিটির নেট আয় হয়েছে ৫৭৪ কোটি টাকা।

এনসিটিতে রয়েছে বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির গ্যান্ট্রি ক্রেন। প্রয়োজন ছিল ১২টি, সেখানে চালু রয়েছে ১৪টি। রাবার-টায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেন রয়েছে ৩৩টি, যেগুলোর কার্যক্ষমতা কমপক্ষে ২০ বছর। টার্মিনালের বার্ষিক সক্ষমতা ১০ লাখ কনটেইনার হলেও গত বছর হ্যান্ডেলিং হয়েছে প্রায় ১২ লাখ ৮১ হাজার টিইইউএস। দক্ষ জনবল ও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় এখন এটি ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউএস পর্যন্ত হ্যান্ডেল করতে পারছে।

২০২৩ সালের মার্চে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটি এনসিটিকে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) পরিচালনার অনুমোদন দেয়। ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পায় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। সেই প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে জিটুজি চুক্তিতে এনসিটি পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে।

২০০৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এনসিটিতে হ্যান্ডেল হয়েছে মোট ১ কোটি ২৩ লাখ ৯৭ হাজার ২০১ টিইইউএস কনটেইনার ও ৮ হাজার ৭৯১টি জাহাজ। উন্নত অবকাঠামো ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় দেশের আমদানি–রপ্তানি খরচ যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে বন্দরসেবার গতি।

চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু। এর মধ্যে প্রায় হাজার মিটার দীর্ঘ এনসিটি সবচেয়ে বড়। একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌযান হ্যান্ডেল করতে পারে এটি। বাকি তিনটির মধ্যে সিসিটিতে ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) ৩৭ শতাংশ পণ্য ওঠানো-নামানো হয়। ২০২৩ সালের জুনে চালু হওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল এখনো পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য হয়নি।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে এনসিটি যাওয়ার সম্ভাবনার প্রতিবাদে শ্রমিক-কর্মচারী, বন্দর-সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও সাধারণ মানুষ নিয়মিত বিক্ষোভ করছে। তাদের দাবি, টার্মিনালটির সরঞ্জাম, সক্ষমতা ও পরিচালনা দক্ষতা বিশ্বমানের। সুতরাং এটি দেশীয় ব্যবস্থাপনাতেই থাকা উচিত।

আন্দোলনকারীদের ভাষ্য মতে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন হলে তা হোক নতুন বে টার্মিনালে, যা এখনো নির্মাণের অপেক্ষায়। এনসিটি লাভজনক ও আধুনিক হওয়ায় এটিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিলে দেশের আয় কমবে এবং কর্মসংস্থানে ঝুঁকি বাড়বে।

শ্রমিকরা বলছেন, এনসিটি দেশের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। এটি বিদেশিদের হাতে গেলে কর্মীদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। দেশে উপার্জিত অর্থ বিদেশে চলে যাবে, যা মোট বন্দর আয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এনসিটি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে আংশিক ও ২০১৫ সাল থেকে পুরোপুরি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করছে। বন্দরের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়-এমন কিছু হবে না।

চট্টগ্রাম বন্দর হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনসিটি থেকে মোট আয় হয়েছে ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পেয়েছে প্রতি কনটেইনারে ৬৯৪ টাকা (সাড়ে ৬ ডলার)। খরচ বাদে বন্দরের প্রকৃত আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ ডলার। বিদেশিদের হাতে গেলে এই আয় দর-কষাকষিনির্ভর হয়ে পড়বে। উদাহরণ হিসেবে পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে এখন বন্দর পাচ্ছে কনটেইনারপ্রতি মাত্র ১৮ ডলার।

তবে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছেন, ডিপি ওয়ার্ল্ডের প্রযুক্তি ও পরিচালন দক্ষতা বিশ্বমানের। বড় বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলেও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠানটির ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে পারে।

সম্প্রতি বন্দর দিবস উপলক্ষে এক সভায় চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, এনসিটিকে বিদেশিদের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিদেশি অপারেটর এলে প্রতিযোগিতা বাড়বে, সেবার মান ও দক্ষতা উন্নত হবে এবং অর্থনীতি উপকৃত হবে। তিনি আশ্বস্ত করেন, বিদেশি অপারেটর এলেও দেশীয় কর্মীরা চাকরি হারাবেন না, যেমনটি পতেঙ্গা টার্মিনালের ক্ষেত্রে হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ