মা হারিয়েছেন শিশুকালে, থেকেও ছিলেন না বাবা; ‘হতভাগা’ হাসিব এবার নিজেই চলে গেলেন

শহীদ হাসিবুর রহমান
শহীদ হাসিবুর রহমান  © সংগৃহীত

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রথম দু’দিন সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে এলেও তৃতীয় দিন আর ফেরা হয়নি সাভারের মাদ্রাসা ছাত্র হাসিবুর রহমানের (১৭)। বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি।

শিশুকাল থেকেই হতভাগা ছিল হাসিবুর রহমান। হাসিবুরের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি থানার উত্তর কানাইপুর গ্রামে। বাবা দেলোয়ার হোসেন (৪০) মানসিক ভারসাম্যহীন। মা মোছাম্মৎ আলমাছ মারা গেছেন হাসিবুরের ৫ বছরের সময়। সেই ছোট্ট সময় থেকেই বাজার রোডের আমিন টাওয়ারের ৯ তলায় থাকা বড় চাচা আনোয়ার ঢালী ও চাচী লাইজু বেগমের কাছে মানুষ হতে থাকে হাসিবুর।

আনোয়ার ঢালী ও লাইজু দম্পত্তির রফিকুল ইসলাম রাব্বী নামের একটি ছেলে ও আছিয়া আক্তার ঐশী নামের একটি মেয়ে সন্তান থাকলেও হাসিবুরকে তারা নিজেদের সন্তানের মতোই লালন-পালন করতেন। শিশু হাসিবুরও চাচা-চাচীকেই নিজের বাবা-মা বলে ডাকতেন। হাসিবুরের দাদা মৃত আমিন উদ্দিন ও দাদী সেরাতন নেছা (৬৫)। নানার নাম ছত্তর গাজী (৭০)।
 
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট ২০২৪ সাভারে অনেকেই প্রাণ হারায়। তাদেরই একজন মাদ্রাসা ছাত্র হাসিবুর। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও বছর খানেক হলো মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল সে। মা ও চাচাতো ভাইয়ের শত বাধার মুখেও সেদিন ছুটে গিয়েছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। ঘাতকের ছোঁড়া গুলিতে সেদিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট শাহাদত বরণ করেন হাসিবুর।

প্রিয় হাসিবুরের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না ছোট বেলা থেকে মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করা চাচী (পালক মা) লাইজু বেগম। ছোট ভাইকে হারিয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতর চাচাতো ভাই রফিকুল ইসলাম রাব্বিবও।

শহীদ হাসিবুরের চাচী (পালক মা) লাইজু বেগম বাসসকে বলেন, সেই ৫ বছর বয়স থেকে হাসিবুরকে আমি নিজের সন্তানের মতো কোলেপিঠে করে বড় করেছি। আমার নিজের সন্তানের মতোই ওকেও আমার আরেকটা ছেলে মনে করাতাম। বড় ছেলের জন্য কিছু কিনলে ওর জন্যও একটা কিনে আনতাম।

২০১৮ সালে আমার স্বামী আনোয়ার ঢালী মারা গেলে হাসিবুরসহ আমার ২ ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়ি। তখন আমি সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমার স্বামীর ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব নেই। সহযোগিতার জন্য সাথে নেই আমার বড় ছেলে রাব্বীকে। একমাত্র মেয়েকে মাদ্রাসার হোস্টেলে দিয়ে দুই ছেলে রাব্বাী ও হাসিবুরকে নিয়েই সাভার বাজার রোডের আমিন টাওয়ারের ৯ তলায় থাকতাম। তবুও আমি আমার ৩ সন্তানের কাউকে অভাব বুঝতে দেইনি।

ঘাসিবুর ছোটবেলা থেকেই ছিল স্বাধীনচেতা। অতন্ত ভালো ছিল হাসিবুর। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই আমারদেরকে না জানিয়ে আন্দোলনে অংশ নিত হাসিবুর। এরকম না বলে আন্দোলনে চলে যাওয়ায় ওকে অনেকবার বারন করি আন্দোলনে যেতে। তবুও বাধা উপেক্ষা করে ছুটে যেত আন্দোলনে। এরকম করে ও দু’দিন ছুটে যায় আন্দোলনে।

ঘটনার দিন ৫ আগস্ট ২০২৪ আমি ও আমার বড় ছেলে রাব্বী এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে যাই আমাদের ব্যবসায়িক কাজে। কাজে যাওয়ার আগে হাসিবুরকে বাসায় রেখে আসি, আর বলি বাবা তুমি বাসা থেকে বের হইওনা।

আমি রাব্বীকে ঘরের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রেখে আসার কথা বললেও ও তা করেনি। সেদিনও হাসিবুর আমরা বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেয়।

এসময় অন্ধ মার্কেটের সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় হাসিবুর। পরে আমরা হাসিবুরকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাই। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করে হাসিবুর।

ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লাইজু বেগম বলেন, সেই টেবিলে, পড়ার কিতাব, কোরআন শরীফ, দূরবীন-এসবের মাঝেই খুঁজে ফেরেন সন্তান হাসিবুরকে। সন্তানের গুলিবিদ্ধ হওয়া, মৃত্যু কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না তিনি।

শহীদ হাসিবুর রহমানের চাচা আতাউর ঢালী মুঠোফোনে বাসসকে বলেন, হাসিবুর খুব ভালো ছিল। ছোটবেলায় ওর মা মারা যাওয়ার পর আমরাই ওকে লালন-পালন করি। ওর বাবাও মানসিক প্রতিবন্ধী। বাবা-মা না থাকলেও সবকিছুই বুঝত হাসিবুর। কখনও কোন জিনিসের জন্য ঝামেলা করেনি। আমরা সবাই ওকে আদর করতাম। তিনি হাসিবুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

শহীদ হাসিবুর রহমানের দাদী সেরাতন নেছা মুঠোফোনে বাসসকে বলেন, নাতি হারানোর শোক এখনো ভুলতে পারিনি। ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছে হাসিবুর। বাবা থেকেও নেই। আমিই ওকে কোলেপিঠে করে বড় করি। কিছুদিন হলো ও ওর চাচা-চাচীর ওখানে থাকে। তিনি বলেন, বাবা-মা হারা হাসিবুরও আজ নেই। ওর স্মৃতি আমাদের ভীষণ কষ্ট দেয়।
   
শহীদ হাসিবুরের ভাই (চাচাতো ভাই) রফিকুল ইসলাম রাব্বী বাসসকে বলেন, হাসিবুর ছোটবেলা থেকেই ছিল অনেক চঞ্চল। আমরা বাসার সবাই ওকে অনেক আদর করতাম। বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল আমাদের। হাসিবুর পাশে থাকলে ভীষন ভরসা পেতাম। সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার আগে টাকা চাইলে টাকা না থাকায় ছোট ভাই হাসিবুরকে টাকা দিতে না পারার বিষয়টি কষ্ট দেয় তাকে।

রফিকুল ইসলাম রাব্বি বলেন, হাসিবুরকে বাসায় রেখে ৫ আগস্ট আমি আর আমার মা কাজে বেরিয়ে যাই। পরে দুপুরের দিকে আমার ছোট চাচার ছেলে আবিদ সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখে আমাকে জানায়। পরে আমি আর আমার মা গিয়ে দেখতে পাই হাসিবুর হাসপাতালের স্ট্রেচারে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় হাসিবুর মৃত্যুবরণ করে। পরে গ্রামের বাড়ী মাদারীপুরের কালকিনির উত্তর কানাইপুর গ্রামে হাসিবুরকে দাফন করা হয়।

শহীদ হাসিবুরের চাচাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা এবং অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়াতা পেয়েছে। হাসিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি।
                  
সরকার অসহায় এসব পরিবারের পাশে দাঁড়াবে, দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে- এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence