চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করুন, আর গালগল্প নয়
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০১৯, ০৫:৫৬ PM , আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯, ০৬:০৭ PM
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ সময়ের একটি আন্দোলন। যে আন্দোলনটি এদেশের লক্ষ কোটি তারুণ্যের অস্তিত্ব রক্ষা তথা টিকে থাকার আন্দোলন। বড় আফসোসের বিষয় দু’চারজন আমলা আর রাজনীতিবিদের গড়িমসির কারণে ৩৫ এর দাবি আলোর মুখ দেখছে না। জোর করে তারুণ্যের শক্তি ও মেধাকে দমিয়ে রাখাটা তাদের যেন অভিলাষে পরিণত হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর উপরে। শুধু বাংলাদেশই ভিন গ্রহের দেশ হিসেবে বয়স রাখা হয়েছে ৩০। যা রীতিমতো অযৌক্তিক ও সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের বরখেলাপ।বিভিন্ন সময়ে চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অজানা কারণে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বয়স বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেওয়া হলেও নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার পর তারা বেমালুম ভুলে আছেন।
এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করা মনে হচ্ছে তাদের জন্য এলার্জি হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিভিন্ন অযৌক্তি-কুযুক্তি দেখিয়ে ৩৫ এর দাবিকে নাকচ করছেন। যদি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ৩০ এর উপর বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে আমাদের বয়স বৃদ্ধিতে এতো অজুহাত ও কালক্ষেপণ কেন? আপনারা কথায় কথায় দেশটাকে কানাডা, সিঙ্গাপুর, জাপান আবার কখনো কখনো আমেরিকা বানাতে চান। কিন্তু বিশাল সংখ্যক তরুণ যুবাদের বঞ্চিত রেখে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বর্তমান বয়সসীমা বিশ্বের ১৬২টি দেশের সর্বনিম্ন বয়সের চেয়েও পাঁচ বছর কম। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো উন্নত দেশে চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছর। হাতেগোনা বিশ্বের কয়েকটি দেশে চাকরির সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বছর হলেও বাংলাদেশে তার চেয়েও কমিয়ে ৩০ বছরে রাখা হয়েছে।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো চিন্তায় আছে সরকার প্রয়োজন হলে বাড়াতে পারে। সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। গতকাল সিলেটে নজরুল অডিটোরিয়ামে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন- সিআরআই’র সহযোগিতায় ‘গৌরবের অভিযাত্রায় ৭০ বছর: তারুণ্যের ভাবনায় আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। শুধু কথামালার ফুলঝুরি নয় তরুণ সমাজ বয়স বৃদ্ধির বাস্তবায়ন চায়। কালক্ষেপন করে আশাকরি তারুণ্যের স্বপ্ন ভঙ্গের নীরব ঘাতক হবেন না। পাকিস্তান আমলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৫ বছর, পরবর্তীতে তা ২৮ করা হয়,এর পর এখন ৩০ হয়েছে। এছাড়া ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। ১৯৯১ সালে তা বাড়িয়ে বিএনপি সরকার ৩০ বছর করে। এরপর আর বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি।যদিও এখন মানুষের গড় আয়ু অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা সেই অনুপাতে বাড়ানো হয়নি। যা খুবই দুঃখের ও হতাশাজনক।
২০১৪ সালে গড় আয়ু ছিল ৭০ দশমিক ৭ বছর,২০১৫ সালে ৭০.৯ বছর, ২০১৬ সালে ৭১.৬ বছর, ২০১৭ গড় আয়ু ৭২ বছর, বিগত বছরগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কিছুটা বেড়ে ৭২ দশমিক ৩ হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষের আয়ু ৭০ দশমিক ৮ বছর আর নারী ৭৩ দশমিক ৮ বছর।
আওয়ামী লীগ সরকার ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে সরকার গঠন করলেও বয়স বাড়ায়নি। এমনকি নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামীলীগ বয়স বৃদ্ধির কথা বললেও এখন বেমালুম ভুলে আছে। যদিও সরকার ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকারি চাকরিতে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ২ বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করে। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়স এক বছর বাড়িয়ে ৬০ বছর করে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং সরকারের একটি পক্ষ ও আমলারা বয়স বৃদ্ধির প্রস্তাবনা আটকিয়ে রেখেছেন। ৩৫ প্রত্যাশী তরুণদের এখন কাজ হলো জনমত জনসংযোগ অব্যাহত রাখা। পাশাপাশি ইতোমধ্যে ৩৫ ঊর্ধ্ব নেতৃত্বকে অবসরে পাঠিয়ে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, এ জনবান্ধব আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া। রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের ওপর ৩৫ এর ভাগ্য নির্ভর করছে। মাটি কামড়িয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেলে , বিফল হবেন না।সেক্ষেত্রে ৩৫ এর ঘোষণা আসতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।তরুণদের জন্য আজ বলতে হয় নজরুলের সেই ‘যৌবনের গান’, প্রমথ চৌধুরীর ‘যৌবনে দাও রাজটীকা’ সবই কি কেন যেন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। তাই তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তরুণ বা নওজোয়ানদের সম্পর্কে বলেছেন,
অসম্ভবের অভিযানে এরা চলে,
না চলেই ভীরু ভয়ে লুকায় অঞ্চলে!
এরা অকারণ দুর্নিবার প্রাণের ঢেউ,
তবু ছুটে চলে যদিও দেখেনি সাগর কেউ
পাহাড়ে চড়িয়া নীচে পড়ে—নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
অজগর খোঁজে গহ্বরে—নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
চড়িয়া সিংহে ধরে কেশর—নৌজোয়ান!
বাহন তাহার তুফান ঝড়—নৌজোয়ান!
শির পেতে বলে—‘বজ্র আয়!’
দৈত্য–চর্ম-পাদুকা পায়,
অগ্নি–গিরিরে ধরে নাড়ায়—নৌজোয়ান।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক