আবেদন ৯ হাজার, এমপিওভুক্ত হচ্ছে ২ হাজার ৭৬২ প্রতিষ্ঠান

প্রায় সাড়ে নয় হাজার আবেদনের বিপরীতে মাত্র ২৭শ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির জন্য চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এমপিওভুক্তির জন্য বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসা শিক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘ দশ বছর পর এমপিওভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও যদি তিন-চতুর্থাংশ প্রতিষ্ঠানকেই বাদ দেয়া হয় তবে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ অবস্থায় সরকারকে দাবি মানাতে শিগগিরই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নতুন কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনার কথাও জানান তারা।

এদিকে সর্বশেষ গত মার্চে শিক্ষকরা এমপিওর দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি নিজে গিয়ে শিক্ষক প্রতিনিধিদলকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিলে রাস্তা ছেড়ে দেন শিক্ষকরা। তবে ওই ঘোষণার পর দেড় মাস পার হলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি শিক্ষকদের। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয়েছেন শিক্ষকরা। নন-এমপিও শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সপ্তাহখানেকের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল। যেখানে তারা নিজেদের দাবির পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে চান বলেও যায়যায়দিনের কাছে দাবি করেছেন শিক্ষকরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ না দিয়ে কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে আন্দোলন থেকে শিক্ষকদের সরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন শিক্ষকরা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, নীতিমালা অনুসারে তারা ২ হাজার ৭৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওর জন্য তালিকাভুক্ত করেছেন। গত বছরের জুলাইয়ে এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যানারে কয়েক হাজার শিক্ষকের প্রায় এক মাস অনশনের পর সরকারের তরফ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওর জন্য আবেদন করতে বলা হয়। যার প্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিম্ন-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ৯ হাজার ৬১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে তাদের আবেদন জমা দেয়। এরপর সরকারের করা নীতিমালা অনুসারে যোগ্য প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভেরিফিকেশন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের ভেরিফিকেশন অনুসারে প্রায় সাড়ে নয় হাজার প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও তারা মাত্র ২ হাজার ৭৬২টি যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেয়েছে। যেগুলো এমপিওভুক্তির শর্ত পূরণ করে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এমপিওভুক্তির জন্য চারটি মানদন্ডের ভিত্তিতে আবেদন নেয়া হয়েছে। এই মানদন্ডগুলো হলো প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পরীক্ষায় পাসের হার। প্রতিটি মানদন্ডের জন্য ২৫ নম্বর রাখা হয়। এসব মানদন্ডের ভিত্তিতে ৯ হাজার ৬১৪টির মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীনে স্কুল ও কলেজ ১ হাজার ৬২৯টি, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের অধীন মাদ্রাসা ৫৫১টি এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৫৮২টি মিলে মোট ২ হাজার ৭৬২টি প্রতিষ্ঠান যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এগুলোর জন্য লাগবে মোট ১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য লাগবে প্রায় ৭২৮ কোটি টাকা। বাকি টাকা লাগবে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য।

তবে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন বলছে, সরকারের করা নীতিমাল সাম্প্রতিক সময়ে প্রণীত। এবং তাতে অনেক বেশি কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক আগ থেকে শিক্ষাক্রম চালিয়ে আসছে। ফলে বছরখানেক আগে করা নীতিমালা নয় বরং পুরান নীতিমালার আওতায় তাদেরকে এমপিওভুক্ত করতে হবে। এবং সে নীতিমালার আওতায় যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ পড়ে তবে তাতে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ দাবিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী বলেন, ‘দীর্ঘ দশ বছর পর এমপিওভুক্তির একটি কার্যক্রম শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি। এ জন্য আমাদেরকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রায় সাড়ে নয় হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওর জন্য আবেদন করেছে। আমরা চাই সরকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করবে। অনেকের কাছে মনে হতে পারে সাড়ে নয় হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। কিন্তু এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে গত দশ বছরে দেশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া দশ বছর পূর্বে যখন এমপিওভুক্ত করা হয় তাও সংখ্যায় ছিল খুবই সীমিত। সবকিছু বিবেচনায় নিলে সাড়ে নয় হাজার বেশি নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জেনেছি মাত্র আড়াই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা এটা প্রত্যাশা করি না। এখন যে নীতিমালা করা হয়েছে তা অনেক কঠোর। এর আওতায় এমপিওভুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কয়েক দশক ধরে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তারা পুরান নীতিমালার আওতায় প্রতিষ্ঠিত। ফলে তাদেরকে পুরান নীতিমালার আওতাতেই এমপিওভুক্ত করতে হবে। সরকার যদি মাত্র এই কয়টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিও করে আমাদেরকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনতে চায় তবে তা ঠিক হবে না। আমাদের দাবি পুরান নীতিমালার আওতায় এমপিও করা হোক। তাতে যদি কেউ বাদ যায় তাতে আমাদের আপত্তি থাকবে না। আর এর ছাড়া ভিন্ন কিছু হলে আমাদেরকেও ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। প্রয়োজন হলে আমরা আবারও আন্দোলনের কর্মসূচিতে যাব।’

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ড. বিনয় ভূষণ রায় এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের দাবি অত্যন্ত পরিষ্কার। আবেদনকৃত সব প্রতিষ্ঠানকেই এমপিওভুক্ত করতে হবে। তবে সরকার বিষয়টি কিভাবে দেখছে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কারণ গত মার্চে যখন আমরা প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনে ছিলাম তখন শিক্ষামন্ত্রী নিজে এসে আমাদেরকে কথা দিয়েছিলেন তিনি আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন। আমরা নিজেরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের সমস্যা তুলে ধরতে চাই। কারণ আমরা মনে করি প্রধানমন্ত্রীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সমস্যা জানতে দেয়া হচ্ছে না। এ কারণে আমরা নিজেরা তাকে বাস্তব অবস্থা জানাতে চাই। কিন্তু দেড় মাস হয়ে গেলেও আমাদেরকে দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়নি।’

শিক্ষকদের এসব বক্তব্য নিয়ে অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নীতিমালার আওতায় এমপিওভুক্ত হতে হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু এর বাইরে শিক্ষকদের দাবির মুখে সরকার বাড়তি আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করবে কিনা এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নামে বক্তব্য প্রকাশ করা উচিত হবে না।’


সর্বশেষ সংবাদ