বইমেলার একাল ও সেকাল
- মো. আল আমিন মাসুদ
- প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:২২ AM , আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:৪৯ AM
দরজায় কড়া নাড়ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলাদেশের লেখক-পাঠক আর প্রকাশকদের এক মিলন-মেলাও বলা যায়। যেটি স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় মেলাগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিবছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণ ও এর আশপাশ ঘিরে চলে বইপ্রেমীদের প্রাণের এই মেলা। লেখক পাঠকের আড্ডা, নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে মোহিত হয় বাংলা একাডেমির আশপাশ।
বইমেলার সাথে আমরা সবাই কমবেশী পরিচিত হলেও খুব কম মানুষই হয়তো জানি এর ইতিহাস বা পেছনের গল্প। চলুন জেনে নেই বই মেলার একাল-সেকাল। ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় প্রথম শুরু করেন ছোট্ট একটি বইমেলার।এই বইগুলো ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতিষ্ঠিত ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ বর্তমানে যেটির নাম ‘মুক্তধারা প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত। যা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। আর সেখান থেকেই শুরুটা হয়।
তবে শুরু হলেও ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বইমেলা খুব জনপ্রিয় হতে পারিনি বা সবাই এর সাথে ততটা পরিচিতও ছিলনা। বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠান সূচিতেও এই কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ করা হয়নি। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মেলা উপলক্ষে বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একাডেমির প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে এবং মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সসহ আরো কিছু প্রকাশনী বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৪ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এর উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সম্মেলনকে কেন্দ্রকরে বাংলা একাডেমি নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। আর এতে কিছু প্রকাশক একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এভাবেই বাংলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই চলে বইমেলার শুরুর দিকের দিনগুলো।
তবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকীর উদ্যোগে বাংলা একাডেমি মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। পরের বছর মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। তখন থেকেই প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির ৭ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত মোট ২১ দিন অনুষ্ঠিত হতো বইমেলা। মাঝে ১৯৮১ সালে বইমেলার সময়সীমা কমিয়ে ১৪ দিন করা হলেও প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে পুনরায় ২১ দিন করা হয় মেলার সময়সীমা ৷ ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা বইমেলার মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেন। আর ১৯৮৪ সাল থেকে মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। মূলত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের করুণ স্মৃতিকে স্মরণ রাখতেই এই মেলার নামকরণ হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ যা এরপর থেকে নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সম্প্রসারিত হয়।
বর্তমানে ছোট বড় পাঁচশরও বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সারিবদ্ধ সাজানো স্টল থাকে মেলায়। সেখানে যেমন থাকে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল তেমনি শিশুদের জন্যও থাকে আলাদা শিশু কর্নার। এছাড়াও বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখকদের জন্য থাকে আলাদা আলাদা স্টল। মেলায় প্রতিদিন নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনসহ অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।