আধুনিকায়নের অভাবে পাঠকবিমুখ ফেনী সরকারি গ্রন্থাগার

ফেনী সরকারি গ্রন্থাগার
ফেনী সরকারি গ্রন্থাগার  © টিডিসি ফটো

ফেনী শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ফেনী সরকারি গ্রন্থাগার ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পাঠকদের জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে এটি শিক্ষার্থী, গবেষক এবং বইপ্রেমীদের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছে। বর্তমানে গ্রন্থাগারটি আরও সমৃদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের আকৃষ্ট করতে এবং চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রস্তুতির জন্য হালনাগাদ ও প্রয়োজনীয় বই সংযোজনের প্রয়োজন রয়েছে। পাঠকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বইয়ের সংগ্রহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হলে এটি আরও কার্যকর হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন পাঠক সমাজ। তারা বলেন, পাঠকদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণে গ্রন্থাগারের পরিসর ও বইসংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে এটি ফেনীর পাঠকসমাজের জন্য আরও সমৃদ্ধ একটি পাঠকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।

জানা যায়, ফেনীতে সরকারি উদ্যোগে গ্রন্থাগার থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বর্তমানে ফেনী সরকারি গ্রন্থাগার, শহরে ট্রাংক রোডে অবস্থিত নবীন চন্দ্র সেন পাবলিক লাইব্রেরি, এবং ফেনী সরকারি কলেজ লাইব্রেরি বিদ্যমান। এছাড়া, ফেনীর নিকটবর্তী পরশুরাম উপজেলায় ভাটিয়াল মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার থাকলেও অঞ্চলভিত্তিক পাঠাগারের অভাবে পাঠকেরা বই পড়া থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে।

ফেনী সরকারি গ্রন্থাগার সূত্রে জানা যায়, জ্ঞানমনস্ক আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ১৯৬৫ সালে প্রকল্পের মাধ্যমে ফেনী জেলা গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ১৯৯১ সালে গ্রন্থাগারটি সরকারিকরণ করা হয়। পরে ২০০৮ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে (ওয়াবদা মাঠের উত্তর পার্শ্বে) নিজস্ব সম্পদের উপর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ২০০৯ সালে ২৬ জুলাই পুরোদমে এই গ্রন্থাগারটির কার্যক্রম শুরু হয়। ৫ হাজার ৬০০ বর্গফুটের গ্রন্থাগারটিতে পাঠকদের বই পড়ার জন্য ১টি কক্ষ রয়েছে। সূত্রে আরও জানা যায়, গ্রন্থাগারের শুরু থেকে ৯টি পদ থাকলেও তার বিপরীতে বর্তমানে রয়েছে মাত্র তিন জন। বর্তমানে লাইব্রেরিতে উপন্যাস, বাংলা সাহিত্য, ইসলামী ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, চিকিৎসা বিজ্ঞান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসসহ বিভিন্ন ধরনের ৩৩ হাজার বই রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ১২৫০টি নতুন বই সংযোজন করা হয়। গ্রন্থাগারটি সপ্তাহে শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকে বলে জানা যায়। 

গ্রন্থাগারটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ১৪-১৫ জন পাঠক গভীর মনোযোগ সহকারে বই পড়ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মূলত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং বি.সি.এস পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী। তবে এর বাইরে সাধারণ পাঠকদের উপস্থিতি তেমন দেখা যায়নি।

পাঠকদের মতে, গ্রন্থাগারের পরিবেশ নিরিবিলি হওয়ায় পড়ালেখার জন্য উপযোগী, তবে আসন বিন্যাসে কিছু অসুবিধা রয়েছে। ওপেন কক্ষে পাশাপাশি বসার কারণে একে অপরের প্রতি দৃষ্টি পড়ে, যা মনোযোগের বিঘ্ন ঘটায়। তাদের পরামর্শ, যদি বসার ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনা হয় এবং ব্যক্তিগত মনোনিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রন্থাগার তার মূল উদ্দেশ্য আরও ভালোভাবে পূরণ করতে পারবে।

ফেনী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ইউসুফ আলী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলে, এই গ্রন্থাগারটিতে অধিকাংশ পাঠক ভর্তি ও চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আসেন। কিন্তু গ্রন্থাগারে উপন্যাস ও গল্পের বই বেশি থাকায় শিক্ষার্থীরা বিসিএস, ব্যাংক জব ও আইইএলটিএস প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় বইয়ের সংকট অনুভব করছেন। তাই এসব বই যুক্ত করা হলে চাকরি প্রত্যাশীরা উপকৃত হবে এবং গ্রন্থাগারটি পাঠকে মুখরিত থাকবে।

বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে গত তিন মাস ধরে নিয়মিত গ্রন্থাগারটিতে আসছেন চাকরিপ্রত্যাশী বিথী। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গ্রন্থাগারটির পরিবেশ নিরিবিলি ও সুন্দর, যা মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়ক। বিশেষ করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়তে পারেন তিনি। তবে শীতকালে পরিবেশ অনুকূল থাকলেও গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত গরমের কারণে পাঠকদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ কারণে গ্রন্থাগারটিতে সোলার প্যানেল বা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রপাতি স্থাপনের দাবি জানান তিনি, যাতে পাঠাগারটি সারা বছরই পাঠকদের জন্য আরামদায়ক থাকে।

চাকরিপ্রত্যাশী মোরশেদ আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অনেক সময় গ্রন্থাগারে সকালে আসলে বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। যারা বই পড়ে এবং বই পিপাসু, তাদের সময় কিভাবে কাটে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কখনো কখনো দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ অবস্থায়, দুপুরের খাবারের জন্য যদি পাঠাগারে একটি ক্যান্টিন ব্যবস্থা করা হতো, তবে পাঠকরা উপকৃত হতো। তাই তিনি গ্রন্থাগারে একটি ক্যান্টিন স্থাপনের দাবি জানান।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আর এই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করতে বই পড়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন শিক্ষার্থী আব্দুল আজিজ। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জেলার গ্রন্থাগারগুলো শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন গ্রন্থাগারের মানোন্নয়ন। তিনি আরও বলেন, যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য একটি জাতিকে সঠিক পথ দেখায়, সেইসব মূল্যবান বই সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। তাই তিনি সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বই সংরক্ষণের দাবি জানান।

ফেনী শহরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আবুল কালাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ফেনী শহরে একটি সরকারি গ্রন্থাগার থাকা নিঃসন্দেহে একটি সৌভাগ্যের বিষয়। তবে, এটি দুঃখজনক যে, আমাদের তরুণ সমাজ এই গ্রন্থাগারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞান অর্জনের চাহিদা এবং মেধার বিকাশের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রযুক্তির যুগে, যখন স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য সহজেই পাওয়া যায়, তখনই আমাদের তরুণদের মধ্যে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে, তাদেরকে পাঠাগারে আসতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা উচিত।

জেলা সরকারি গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মো. কামরুল হাছান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের গ্রন্থাগারটিতে মোট ৩৩ হাজার বই রয়েছে। পাশাপাশি ৯ জন জনবলের মধ্যে তিনজন রয়েছে। এছাড়া একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি রয়েছে যেটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে প্রদর্শিত করা হয়। সেখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বই পড়তে পারেন।

সরকারি গ্রন্থাগারে চাকুরী প্রার্থীর বই রাখার নিয়ম নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল বুক স্ট্যান্ডার্ড নাম্বার (আইএসবিএন) আওতার যে সব বই রয়েছে সেই সব বই গ্রন্থাগারে রাখার সুযোগ আছে। এর বাইরে অন্য কোন বই এখানে রাখার সুযোগ নেই।

পাঠক সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রযুক্তির কারণে পাঠক সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে, গ্রন্থাগারে বসে বই পড়ার পাঠক কমলেও, চাকরি প্রত্যাশী পাঠকরা নিয়মিতভাবে গ্রন্থাগারে আসছেন। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক পাঠক বই পড়তে গ্রন্থাগারে আসেন বলে জানায় তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ