বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
১১ বছরে অনার্স পাস করা সেই ছাত্রলীগ নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি
- বাকৃবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:০০ PM , আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:২৯ PM
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) বিভিন্ন বিভাগ ও শাখায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে দেখা গেছে, ১১ বছরে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রার্থীকেও চাকরি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যহীন দপ্তরে উপ-উপাচার্যের একান্ত সচিব ও সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে।
অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সরবরাহ বিভাগে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা (৯ম গ্রেড) হিসেবে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আতিক শাহরিয়ার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ২০১০-১১ সেশনের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক।
স্নাতক ভর্তির ১১ বছরের মাথায় ডিগ্রি অর্জন করতে না পারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসানের বিশেষ অনুগ্রহে সিন্ডিকেট মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালে তাকে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এমন প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ায় প্রশ্ন উঠেছে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। অভিযোগ আছে, বাকৃবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমানের একান্ত আস্থাভাজন হওয়ায় চাকরি পেয়েছেন আতিক।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাকৃবি শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান পিয়ালকে। অথচ ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য পদটি শূন্য অবস্থায় আছে এবং গত বছর থেকে এই দপ্তর তুলে দেওয়া হয়েছে। একই দপ্তরে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সিয়াম আহমেদকে। এই দপ্তরহীন পদে নিয়োগ দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন ।
এদিকে একাধিক পদে নিয়োগ হওয়ার পরও ওই পদগুলোতে সংশ্লিষ্ট শাখা ও বিভাগে যোগদান না নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি ফার্মের ফার্ম ম্যানেজার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুল ইসলামকে। কিন্তু সেই পদে যোগদান করতে গেলে তা গ্রহণ করেন নি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান ড. এ কে এম মাসুম। কারণ হিসেবে তিনি জানান, ‘তার যোগদান না নেওয়ার কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে’।
পাশাপাশি কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের ওয়ার্কশপ টেকনিক্যাল অফিসার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ফরহাদ হোসেনকে। কিন্তু ওই পদেও তার যোগদান গ্রহণ করেননি কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগ। শিক্ষাগত যোগ্যতা আর কর্মদক্ষতার অভাব বোধ করায় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। তাকে নিয়োগ দেয়া হলে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও জানান তারা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি পর ১৪ সেমিস্টার অর্থাৎ ৭ বছরের মধ্যে ডিগ্রি অর্জন হয়। সে হিসেবে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আতিকের ডিগ্রি নেওয়ার শেষ সময় ছিল ২০১৮ সাল। কিন্তু হঠাৎ ২০২২ সালের ২০ আগস্ট শিক্ষা পরিষদের এক জরুরি সভায় আতিকসহ ৬ শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি দেওয়ার বিষয়টি তোলা হয়। পরে ফেল করা বিষয়গুলোতে শেষবারের মতো পরীক্ষা দিতে পারবেন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সভায়।
তখন কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, করোনায় মানবিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু করেনরা শুরু হয় ২০২০ সালে। তবে আতিকসহ ৪ শিক্ষার্থীর ডিগ্রি নেয়ার শেষ সময় ছিল ২০১৮ ও ২০১৯ সাল। তাহলে তারা করোনার মানবিক বিবেচনায় কিভাবে আসলো সেই প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে।
১১ বছরে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের বিষয়ে আতিক শাহরিয়ার বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্নাতক সম্পন্নের জন্য আমার ১৪টি সেমিস্টার পাওয়ার কথা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেরিতে ফলাফল প্রকাশ করার কারণে আমি পেয়েছি ১২ সেমিস্টার। এ দায়ভার তো আমার নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে আমাকে অনেক পরে পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দিলে আমি স্নাতক সম্পন্ন করি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আবেদন করে সকল পর্যায় সম্পন্ন করে চাকরিতে মনোনীত হয়েছি।
নিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. অলিউল্লাহর নিকট একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে একাধিকবার সরাসরি দেখা করতে গেলে তিনি বিভিন্ন অজুহাতে দেখা করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, যোগদানকারীদের যোগ্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন হলে সংশ্লিষ্ট পদের জন্য তিনি যোগ্য। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কয়েক দশকের পুরাতন, আমরা সেটা আপডেট করার চেষ্টা করছি।
১১ বছরে পাশ করে চাকরিতে মনোনীত হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, সিন্ডিকেট বৈঠক ব্যতীত লিখিত পরীক্ষা থেকে শুরু করে সকল কার্যক্রম পূর্ববর্তী বোর্ড সম্পাদন করেছে। আমরা কেবল প্রার্থীর কাগজপত্র দেখেছি এবং তা সঠিক ছিল বলে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি।
নিয়োগের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগদান না নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রার্থীরা বিজ্ঞাপনের যোগ্যতা অনুযায়ী মনোনীত হয়েছে। তাই কর্তৃপক্ষের যোগদান না নেওয়ায় আমরা অন্যত্র যোগদানের ব্যবস্থা করেছি। তবে উপ-উপাচার্যের দপ্তর না থাকা সত্ত্বেও সেখানে যে নিয়োগটা হয়েছে সেটা পূর্ববর্তী প্রশাসন নির্ধারণ করে গিয়েছেন, এখানে আমার কোনো বিষয় নেই। ওই দপ্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত দুজনকে প্রয়োজন অনুসারে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে থেকে যাওয়া ফাঁকা স্থানগুলোতে পরবর্তীতে বিজ্ঞপ্তি আপডেট করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।