‘অটো পাস’ এর অভিশাপ, পরীক্ষার আগেই একের পর এক স্বপ্ন ভঙ্গ
- আরিফুল ইসলাম তামিম
- প্রকাশ: ০১ মে ২০২১, ০১:০৫ PM , আপডেট: ০১ মে ২০২১, ০১:৫৮ PM
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি লড়াইয়ে নামে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন জুড়ে থাকে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। গেল বছর ২০২০ সালে মহামারি করোনার কারণে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে এসে ‘অটো পাসে’ বিপাকে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অনেকের কাছে এখন ‘অটো পাস’ আশীর্বাদ নয়, যেন অভিশাপ হয়ে এসেছে।
তথ্য মতে, করোনা প্রকোপ ও ‘অটো পাস’ এর কারণে চলতি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি আবেদন বিজ্ঞপ্তিগুলোতে এসেছে ব্যপক পরিবর্তন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের পার করতে হবে সিলেকশন প্রক্রিয়া। আর আর তাতেই চটেছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা৷ সিলেকশন প্রক্রিয়ার ফলে পরীক্ষার আগেই স্বপ্নভঙ্গ অনেক ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর।
সর্বশেষ, গত বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই সিলেকশন পদ্ধতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হতাশার বিষয়টি ফুটে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার এইএসসিতে ‘অটো পাস’ এর কারণে প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাথমিক আবেদনের দিকে যেতে হচ্ছে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করা নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থীকেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগের কথা বলছে তারা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান বলেন, একের পর এক সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বুয়েট, বুটেক্স, কৃষি, রাবি, গুচ্ছ প্রকৌশল থেকে শুরু করে সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে সিলেকশন পদ্ধতি থাকায় কোথাও পরীক্ষা দিতে পারছিনা। এবার এইচএসসি পরীক্ষা না নেওয়ায় যেহেতু শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা সম্ভব হয়নি তাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় উচিত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে মেধা যাচাই করে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। কিন্তু একের পর এক স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে শুধুই হতাশই হচ্ছি।
আরেক ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী হৃদয় বলেন, জিপিএ-৫ পেয়েও প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেকশন পদ্ধতির কারণে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে না পারার আক্ষেপ আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,গুচ্ছ প্রকৌশল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এসব ছিলো শেষ ভরসা৷ এখন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেখে রীতিমতো হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নাই। সিলেকশন পদ্ধতি বাতিল করা উচিত।
চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে সাফিন বলেন, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন কার না থাকে৷ সেই আশা নিয়ে সামনের পথে হাঁটছিলাম কিন্তু ‘সিলেকশন’ পদ্ধতি এখন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫ হাজার, বুয়েটে ২৪ হাজার, গুচ্ছ প্রকৌশলে ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি বিজ্ঞপ্তির শর্তগুলো এমনভাবে দেয়া হয়েছে যেন যারা বুয়েটে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে, তারাই আবার পরীক্ষা দিবে গুচ্ছ প্রকৌশল, রাবি, জাহাঙ্গীররনগর কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে বাকি শিক্ষার্থীরা যাবে কই? তাদের কি ভর্তি যোগ্যতা নেই? পরিস্থিতির কবলে ‘অটো পাস’ এর মেনে নিলাম কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা কেন দিতে পারবো না? এইচএসসি পরীক্ষা সশরীরে হলে তো চিত্রটা ভিন্ন হতে পারতো।
মেরাজ বলেন, ‘অটো পাস’ এর ফলাফলের উপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বসার জন্য সিলেকশন পদ্ধতি এক প্রকার প্রহসন। সিলেকশন পদ্ধতি বাতিল করা উচিত। একটা নির্দিষ্ট নম্বর বা পয়েন্ট শর্ত হিসেবে দিয়ে দেন, শর্ত অনুযায়ী যোগ্যরাই আবেদন করুক। তাহলে সিলেকশন হবে না জেনেও একবুক আশা নিয়ে আর আবেদন করতে হবে না সব শিক্ষার্থীদের৷এতে ভোগান্তি ও কমে যাবে।সিলেকশন প্রক্রিয়ার ফলে আমার মতো হাজারো স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীর কাছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি শুধু স্বপ্নই থেকে গেল।
আরেক শিক্ষার্থী জিসান বলেন, ‘অটো পাস’ এর ফলাফল বিবেচনায় সিলেকশন পদ্ধতি কতটুকু যৌক্তিক সেটি কর্তৃপক্ষকে আরেকবার ভেবে দেখা উচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন পদ্ধতি ছাড়াই নির্দিষ্ট পয়েন্টের উপর শর্ত বেঁধে দিয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিয়েছে৷ কিন্তু সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেখে আমি হতাশ।
তিনি বলেন, শতভাগ আবাসন সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতি ইউনিটে মাত্র ১৮ হাজার শিক্ষার্থী সিলেকশন প্রক্রিয়া শেষে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। জাবিতে সেকেন্ডটাইমারদের আশা-ভরসার পুরোটাই থাকে জাবির উপর। কিন্তু সিলেকশন প্রক্রিয়া সব স্বপ্ন গুলো ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। অথচ গেল বছরের ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়টির শুধু ‘ডি’ ইউনিটেই ৭৭ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলো।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান জানান, সবাই তাদের পছন্দ মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষায় সবার ভর্তির সুযোগ রয়েছে।
তিনি জানান, বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি, কারিগরি, জাতীয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল সব মিলিয়ে ১৩ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া অনেক শিক্ষার্থীর লক্ষ্য দেশের বাইরে পড়াশোনা করা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হারানো মানে এই নয় যে তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ হারাতে হবে।
জাবি ভর্তিতে বাছাই প্রক্রিয়া প্রশাসনের ‘অমানবিক’ সিদ্ধান্ত: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) স্নাতক শ্রেণির ভর্তি ফরমের মূল্য বৃদ্ধি ও বাছাই প্রক্রিয়াকে প্রশাসনের ‘অমানবিক’ ও ‘মুনাফালোভী’ মানসিকতা দাবি করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
শুক্রবার (৩০ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়েছে জাবি ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র অধিকার পরিষদ।
বিজ্ঞপ্তিতে ভর্তি পরীক্ষার ফি অনধিক ৩০০ টাকা এবং উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষার ফলাফলকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা হিসেবে গণ্য না করার দাবি জানান তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ‘অযৌক্তিক’ সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে আন্দোলন করে প্রশাসনকে বাধ্য করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনগুলো।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) জাবির কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে এ, বি, সি, ডি ও ই ইউনিটের পরীক্ষার যে কোনো একটিতে পরীক্ষা দিতে দুই ধাপে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ১৫৫ টাকা করে এবং অন্যান্য ইউনিটগুলোর ক্ষেত্রে দিতে হবে ৭৫৫ টাকা করে। এ পরিমাণ গত শিক্ষাবর্ষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর ১১৫৫ টাকার স্থলে ছিল ৬০০ টাকা এবং ৭৫৫ টাকার স্থলে ৪০০ টাকা ছিল।
এক বিবৃতিতে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তুষার ধর ও সম্পাদক রাকিবুল রনি বলেন, করোনায় দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, তখন ভর্তি পরীক্ষার ফরমের মূল্য না কমিয়ে উল্টো দ্বিগুণ করা জাবি প্রশাসনের এমন মুনাফালোভী সিদ্ধান্ত দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিবে।
তারা আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি উচ্চমাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষার জিপিএ’র ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা নির্ধারণের ফলে প্রকৃত মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
এদিকে জাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট আহবায়ক শোভন রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আবু সাইদের পাঠানো এক বিবৃতিতে শিক্ষার্থী বাছাই করার নামে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত করাকে ‘অমানবিক’ সিদ্ধান্ত হিসেবে দাবি করা হয়।
ছাত্রনেতারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সম্পূর্ণ অবিবেচনাপ্রসূতভাবে সেই মূল্য প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তার পাবলিক চরিত্র হারিয়ে আরও স্পষ্ট রূপে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্রে অবনমন ঘটালো। মহামারির সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ভর্তি ফরম বাণিজ্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
জাবি ছাত্র অধিকার পরিষদও তাদের বিবৃতিতে প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানান এবং পুনর্বিবেচনার দাবি করেন।