ছবির ভাষায় ইংরেজি মাসের উৎপত্তির গল্প
শুরু হল আরেকটি বছর। নতুন স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফের নতুনভাবে যাত্রা করল বিশ্ববাসী। কিন্তু কীভাবে এলো জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি- ব্যাখ্যাই বা কী? যুগ যুগ ধরে যে মাসের নামগুলো আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সে সব নামের পাশে আছে এক একটি ইতিহাস বা কারণ। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন- ফরহাদ কাদের
খ্রিস্ট বছরের প্রচলন, মাসের নাম, দিনের নামের সাথে রয়েছে ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজে প্রচলিত ধারণার সংমিশ্রিত সম্পর্ক। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি পুরানো রোমান ক্যালেন্ডারকে সংশোধন করে নতুন ক্যালেন্ডার আনেন। তাঁর নামেই ক্যালেন্ডারের নাম হল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আগে ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারেরও আগে রোমানরা গ্রিক পঞ্জিকা অনুযায়ী বছর ধরত ৩০৪ দিনে। যাকে ১০ মাসে ভাগ করা হয়েছিল। এটি শুরু হত বসন্তবিষুবের দিন, যা সাধারণত মার্চের ২০-২১ তারিখ পড়ত। এক সময় রাজা পম্পিলিয়াস দেখলেন ৩০৪ দিন হিসাবে বছর করলে প্রকৃতির সঙ্গে মিলছে না। খৃস্টপূর্ব ৭০০ সালে তিনি বছরের সাথে যোগ করলেন আরও ৬০ দিন। বছরের দিন বৃদ্ধি পেল ঠিকই সঙ্গে সমস্যাও বৃদ্ধি পেল ঋতুর চেয়ে সময় এগিয়ে আছে তিন মাস। তখনই জুলিয়াস সিজার ঢেলে সাজালেন বছরকে। নতুন দু’টি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে এলেন বছরের প্রথম দিকে।
খ্রিস্ট বছরের ১২ মাসের নামের সাথে রয়েছে তাদের ধর্মীয় দেবতা, রাজা-বাদশার নাম। কিছু মাসের নাম অর্থগতভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে। জানা যাক মাসের নামের ইতিকথা-
জানুয়ারি (January): জানুয়ারি মাসের নামের পিছনে আছেন রোমান দেবতা জেনাস। দুই মুখ দিয়ে তিনি সামনে ও পিছনে দেখতে পান। খ্রিস্টজন্মের প্রায় ৬৯০ বছর আগে সম্রাট নুমো পম্পিলিস জানুয়ারি মাসকে বছর শুরুর প্রথম মাস হিসেবে ঘোষণা করেন। দুটি মুখ দিয়ে জেনাস পুরনো ও নতুন বছর দেখতে পাবেন, এই ছিল ধারণা।
ফেব্রুয়ারি (February): প্রাচীন রোমানরা ফ্রেরুয়া নামে একটি ‘শুদ্ধিকরণ উৎসব’ করতেন। উৎসবে ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি চাবুক ‘ফ্রেব্রুয়া’ দিয়ে নিঃসন্তান মহিলাদের অত্যাচার করা হত। মনে করা হত, এর ফলে তাঁরা পবিত্র হয়ে সন্তানের জন্ম দেবেন। সম্রাট পম্পিলিস এই উৎসবের জন্য মাসের নাম রাখেন ফ্রেব্রুয়ারি।
মার্চ (March): রোমান যুদ্ধের দেবতা ‘মার্স’কে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর নাম অনুসারে এই মাসের নামকরণ। প্রাচীন রোমানরা বিপক্ষকে বাধ্য করতেন যাতে সমস্ত যুদ্ধ মার্চ মাসে বন্ধ থাকে। এর কারণ, সেই সময় মার্চ ছিল নতুন বছরের প্রথম মাস ও উৎসবের মাস।
এপ্রিল (April): ল্যাটিন শব্দ ‘এপ্রিল’ এর মানে ‘দ্বিতীয়’ কারণ সেই সময়ের রোমান ক্যালেন্ডারে এপ্রিল ছিল দ্বিতীয় মাস। অন্য তত্ত্ব বলছে, ল্যাটিন শব্দ ‘এপেরিরে’ থেকে এপ্রিল মাসের নামকরণ হয়েছে। আবার অনেকে বলেন, গ্রিক দেবী ‘এফ্রোডাইট’ থেকে এই মাসের নামকরণ হয়েছে।
মে (May): মে মাসের নামকরণের পিছনে আছে আরেক দেবী যার নাম ‘মাইয়া’। প্রাচীন রোমানদের বিশ্বাস ছিল, দেবদেবীর মধ্যে কখন কোন দেবতা পৃথিবীতে নামবেন, তা নাকি দেবী ‘মাইয়া’ ঠিক করে থাকেন।
জুন (June): প্রাচীন রোমানদের কাছে জুন মাস ছিল বিয়ের মাস। এই মাসের নামকরণের পিছনে আছেন রোমানদেবী ‘জুনো’। ইনি ছিলেন দেবতাদের রানী। রোমানদের নারী, চাঁদ ও শিকারের দেবী ছিলেন ‘জুনো’।
জুলাই (July): জুলাই মাসের নামের পিছনে বিখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নাম রয়েছে। এই জুলাই মাসেই সিজার জন্মেছিলেন। সেই সময় অবশ্য এই মাসের নাম ছিল ‘কুইন্টিলিস’। মজার ব্যাপার হচ্ছে বছরের প্রথমে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিকে স্থান দিয়ে তিনি নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে দেন।
আগস্ট (August): আগস্ট মাসের নামকরণ হয়েছে রোমান সম্রাট অগাস্টাসের নাম অনুসারে।
সেপ্টেম্বর (September): ল্যাটিন ‘সেপ্টেম’ মানে সাত। রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ছিল সপ্তম মাস। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে যখন জুলিয়াস সিজার তার নাম অনুসারে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার শুরু করলেন, সেখানে ক্রম অনুসারে প্রথম ছয়টা মাস ঠিক একই থেকে গেল। কিন্তু নতুন দুটো মাস জানুয়ারি ও ফ্রেব্রুয়ারি অতিরিক্ত যোগ হওয়ায় সেপ্টেম্বর হয়ে গেল নয় নম্বর মাস। তারপর এটা কেউ পরিবর্তন করেনি।
অক্টোবর (October): ল্যাটিন ‘অক্টো’ মানে আট আর ‘বার’ শব্দটি বিশেষণ হয়ে সাফিক্স হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। অক্টো শব্দটির অর্থ অষ্টম কিন্তু জুলিয়ান এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে অক্টোবর হচ্ছে দশম মাস।
নবেম্বর (November): একই ভাবে নভেম্বর মাস এল ‘নভেন’ যার মানে নবম থেকে। বাস্তবে নভেম্বর মাস ১১তম মাস।
ডিসেম্বর (December): ল্যাটিন শব্দ ‘ডিসেম' অর্থ দশম। সিজারের বর্ষ পরিবর্তনের আগে এটি ছিল দশম মাস। কিন্তু আজ আমাদের কাছে এ মাসের অবস্থান ক্যালেন্ডারের শেষ প্রান্তে।
সাতদিনের নামসমূহের ইতিকথা:
সাত দিনের নামের অর্থ ভিন্ন রকম। এই সাতদিনের নামের উৎপত্তিস্থল, কিভাবে হলো তার ইতি কথা নিয়ে আছে বিভিন্ন জনশ্রুতি-
শনিবার (Saturday): রোমান সাম্রাজ্যের আমলের লোকেরা এই বলে বিশ্বাস করত যে, চাষাবাদের জন্য ‘স্যাটান’ নামের একজন দেবতা আছেন। যার হাতে আবহাওয়া ভালো খারাপ করার লেখাটি আছে। তাই তাকে সম্মান করার জন্যই তার নামে একটি গ্রহের সাথে সপ্তাহের একটি দিনের নাম স্যাটনি ডেইজ রাখা হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে স্যাটানের দিন। বর্তমানে তা ‘স্যাটারডে’ নামেই পরিচিত।
রবিবার (Sunday): দক্ষিণ ইউরোপের সাধারণ লোকেরা বিশ্বাস করত এবং ভাবত যে, একজন দেবতা রয়েছেন যিনি শুধুমাত্র আকাশে গোলাকার আলোর বল অংকন করেন। ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলা হয় ‘সলিছ’। এর থেকেই সলিছ ডে অর্থাৎ সূর্যের দিন। উত্তর ইউরোপের লোকেরা এই দেবতাকে ডাকত ‘স্যানেল ডেইজ’ নামে। যা পরবর্তীতে বর্তমান সান ডে-তে রূপান্তরিত হয়।
সোমবার (Monday): দক্ষিণ ইউরোপের লোকেরা রাতের বেলায় আকাশের গায়ে রূপালী বল দেখে তারা ডাকত ‘লুনা' নামে। ল্যাটিন শব্দ লুনা ডেইস। উত্তর ইউরোপের লোকেরা ডাকত মোনান ডেইজ। এ মানডে কিন্তু মোনান ডেজ থেকে রূপান্তর হয়।
মঙ্গলবার (Tuesday): রোমান রাজ্যের লোকেরা বিশ্বাস করত যে, টিউ নামক একজন দেবতা আছেন যিনি যুদ্ধ দেখাশুনা করেন। তারা ভাবত যারা টিউকে আশা করত, টিউ তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করত যুদ্ধের ময়দানে এবং যারা পরলোক গমন করেছে তাদেরকে টিউ পাহাড় থেকে নেমে একদল মহিলা কর্মী নিয়ে বিশ্রামের জায়গা ঠিক করত। তারা একে ডাকত ‘ডুইস’ নামে। যার ইংরেজি অর্থ টুইস ডে।
বুধবার (Wednesday): দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘উডেন’ বলে দক্ষিণ ইউরোপের লোকেরা ভাবত। তিনি সারা দিন ঘুরে জ্ঞান লাভ করতেন যার জন্য তার একটি চোখ হারাতে হয়েছিল। এই হারানো চোখকে তিনি সবসময় লম্বাটুপি দিয়ে আবৃত করে রাখতেন। দুটো পাখি উডেনের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করত, তারা উডেনের কাঁধে বসে থাকত। রাতে তারা সারা পৃথিবীর ঘটনাবলি উডেনকে শুনাত। এভাবেই উডেন সারা পৃথিবীর খবর শুনতে সক্ষম হন। এজন্য লোকেরা নাম রাখল ওয়েডনেস ডেইস। যা বর্তমান ওয়েডনেস ডে নামে পরিচিত।
বৃহস্পতিবার (Thursday): বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানোর সম্পর্ক না জানার ফলে মানুষ মনে করত যে, বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানোর জন্য একজন দেবতা দায়ী। তারা শুধু আলো জ্বলতে ও বিদ্যুৎ চমকাতে দেখত। তারা দেবতার নাম রাখে ‘থর’। তাদের মধ্যে এই অন্ধ বিশ্বাস ছিল যে, দেবতা থর যখন রাগান্বিত হন তখন তিনি রাগে আকাশে একটা হাতুড়ি নিক্ষেপ করেন দু’টি ছাগলের গাড়িতে বসে। ছাগলের গাড়ি চাকার শব্দ হচ্ছে বজ্রপাত ও হাতুড়ির আঘাত হচ্ছে বিদ্যুৎ চমকানো। থরের প্রতি সম্মান রক্ষার্থে তারা সপ্তাহের একটি দিনের নাম রাখেন থার্স ডেইস। যাকে আজ আমরা থার্স ডে বা বৃহস্পতিবার বলে ডাকি।
শুক্রবার (Friday): ওডিন একজন শক্তিশালী দেবতা। তার স্ত্রী দেবী ফ্রিগ ছিলেন ভদ্র এবং সুন্দরী। ওডিনের পাশে সব সময় তার স্ত্রী থাকতেন। পৃথিবীকে দেখতেন, প্রকৃতিকে উপভোগ করতেন, প্রকৃতির দেবী ভালোবাসা ও বিবাহের দেবীও ছিলেন ফ্রিগ। এই জন্য লোকেরা বাকি একটি দিনের নাম ‘ফ্রিগ ডেইজ’ বা ফ্রাইডে রাখেন।