বেঁচে থাকলে আজ আলিম পরীক্ষায় বসতো ভোলার শহীদ আরিফ
- ভোলা প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ০৮:১৭ AM , আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫, ০৩:২৩ PM
আজ থেকে সারাদেশে একযোগে শুরু হচ্ছে ২০২৫ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। সহপাঠীদের সঙ্গে এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার আলিম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আরিফেরও। কিন্তু পরীক্ষায় বসার জন্য আরিফ আর নেই।
১৮ বছর বয়সী এই কিশোর ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'-এ অংশ নিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। গুলি লাগে তার ডান চোখের নিচে, মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এক বছর পার হয়ে গেলেও আরিফের পরিবার আজও শোক সামলাতে পারেনি। তার মা ফরিদা বেগম বলেন, কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। সবাই পরীক্ষা দেবে, আর আমার বাবাটা পারলো না—এটা ভাবলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, আরিফ প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ নিতো, সেদিন রাতে শেষবারের মতো কথা হলো, ভাত খেয়েছি কি না, ছোট বোনেরা ঠিকমতো পড়ে কি না এই ছিল তার চিন্তা।
আরিফ ছিল পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই। ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চাঁদপুর এলাকার সেকান্তর মুন্সি বাড়ির সন্তান সে। বাবা মো. ইউসুফ পেশায় কৃষক, অন্যের জমিতে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। ছেলের ভবিষ্যতের ওপরই নির্ভর করছিল পুরো পরিবার। অভাবের কারণে আরিফ ঢাকায় মামাতো ভাই সাহাবুদ্দিনের খাবারের হোটেলে কাজ করতে গিয়েছিল, পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি পরিবারের খরচ জোগাতে।
আরিফের পিতা ইউসুফ বলেন, ও আমার একমাত্র ছেলে ছিল। ওর চিন্তায় একেবারে ভেঙে পড়েছি। অভাবের কারণে তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। আজ মনে হয়, যদি জানতাম এমনটা হবে, কখনোই পাঠাতাম না।
তিনি জানান, বড় কষ্ট করে সন্তানদের পড়াচ্ছেন। দুই মেয়ে এখনো মাদ্রাসায় পড়ে একজন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, অন্যজন সপ্তম শ্রেণিতে। ছেলে থাকলে হয়ত এখন এই পরীক্ষাটা দিয়ে একটা ভবিষ্যতের দিকে হাঁটতো। আজকে কিছুই নেই। ওর মা দিনরাত কাঁদে, বোঝাতে পারি না, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন ইউসুফ।
আরিফের পরিবারের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার হোক। তার মা ফরিদা বেগম বলেন, আমি বিচার চাই, যেই আদেশে আমার বুক খালি হলো, সেই শেখ হাসিনার বিচার দেখে যেতে চাই।
আরিফের মামাতো ভাই সাহাবুদ্দিন জানান, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার হোটেলের জন্য বাজার করতে গিয়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয় আরিফ। সব কিছু এত দ্রুত ঘটেছিল যে কিছু বোঝার সুযোগই ছিল না।
শিক্ষক ও সহপাঠীরাও বলেন, আরিফ একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল, কোনও রাজনীতিতে জড়িত ছিল না। পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের দায়িত্ব নিয়েই তার জীবন চলছিল। আজ সে বেঁচে থাকলে আমাদের মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতেন।
তারা আরও বলেন, আজকের এইচএসসি পরীক্ষার দিনটি তাই লর্ডহার্ডিঞ্জ ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার জন্য কেবল একটি পরীক্ষার দিন নয়, বরং একটি অদেখা স্বপ্ন, হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনার জন্য শোকের দিন। কারণ এই দিনে একজন নিষ্পাপ কিশোরের থাকা কথা ছিল, কিন্তু সে নেই। পরিবার হারিয়েছে তাদের ভরসা, সমাজ হারিয়েছে এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।