র্যাগ ডে নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ধরনের প্রভাব ফেলবে
- ইলিয়াস শান্ত
- প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০৩:২২ PM , আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০৪:০৯ PM
র্যাগ ডে’র নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং, নগ্নতা ও অপসংস্কৃতি বন্ধে হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ১৭ এপ্রিলের ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আগামী ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ নির্দেশনার পর দেশের বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ এ নির্দেশনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। আবার অনেকে এর বিপক্ষেও মত দিচ্ছেন।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র আপত্তি থাকলেও র্যাগ ডে নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে র্যাগ ডে হচ্ছে একটি বিশেষ দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে শিক্ষার্থীরা এ দিনে নানা আয়োজন করেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আনিকা তাসনিম সুপ্তি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তার জায়গা। এখানে তাদের স্বাধীনতা থাকাটা জরুরি। র্যাগ ডের অনুষ্ঠানে সুস্থ বিনোদন, নাচ-গানের চর্চা হতে পারে। মূলত আমরা মূল জায়গা থেকে সরে আসছি। যেখানে এ বিষয়ে সমস্যা রয়েছে সেটা সেখানেই সমাধান করা উচিৎ। এভাবে ঢালাওভাবে নির্দেশনা দেয়া হলে মুক্তচিন্তার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে আসবে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম ব্যাচের বিদায়ী অনুষ্ঠানে আয়োজিত র্যাগ ডে’র একাধিক কর্মসূচি নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে আয়োজনকরা বলছেন, তাদের ৪০টি কর্মসূচির মধ্যে মাত্র ২-১টি কর্মসূচি নিয়ে মানুষজন আলোচনা করছে। বাকিগুলো নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না।
আরও পড়ুন: র্যাগ ডের নামে ‘নগ্ন-অশ্লীল’ কর্মকাণ্ড বন্ধে রিট
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ৪২তম ব্যাচের অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ইসমাইল হোসেন বলেছেন প্রথমে বুঝতে হবে স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ ডে’তে পার্থক্য রয়েছে। স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর চর্চার বিষয়গুলোও ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী মুক্তবুদ্ধি চর্চা করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে অপসংস্কৃতি বন্ধের নামে একজন শিক্ষার্থীদের নিজের মত প্রকাশে বাধার সৃষ্টি করা কাম্য নয়।
তিনি বলেন, শিক্ষা সমাপনী দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের আয়োজিত র্যাগ ডে বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিছু বিষয় নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনাও করেছে। পরবর্তী আয়োজনে আমরা সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করবো। শিক্ষার্থীরা শালীনতা বজায় রেখে স্বাধীনভাবে সাংস্কৃতির চর্চা করবে।
আরও পড়ুন: র্যাগ ডে নিষিদ্ধ নয়, অসৌজন্যমূলক আচরণে নজর রাখবে ঢাবি
এদিকে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগ ডের নামে ডিজে পার্টি, বুলিং, অশ্লীলতা ও নগ্নতা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৭ এপ্রিল হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ কামরুল হাসান। এরপর গত ১৭ এপ্রিল রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আনিকা বলেন, কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে মহামান্য হাইকোর্ট এ নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নির্দেশনাকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এক না হলে দেখা যাবে সবক্ষেত্রে এ নির্দেশনা সমানভাবে কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক বেশি প্রভাব ফেলবে।
আরও পড়ুন: ‘র্যাগিং’ না ‘র্যাগ ডে’, স্পষ্ট করলেন ঢাবি প্রক্টর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণচূড়া সংস্কৃতি সংসদ সাবেক সভাপতি মু. মিনহাজুল আকরাম আকাশ মনে করেন, দীর্ঘদিন একসঙ্গে পড়াশোনা শেষে একটা বিদায়ী অনুষ্ঠান করা হয়। এতে সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চর্চা দীর্ঘদিনের। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। মহামান্য হাইকোর্ট সেই বিষয়টি হয়তো পয়েন্ট আউট করতে চেয়েছেন।
হাইকোর্টের এ নির্দেশনাকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, ঢাবিতে র্যাগ ডে’র নামে কোন ধরনের অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতির সুযোগ নেই। এখানে বরাবরই শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা সমাপনীর দিনে অত্যান্ত আনন্দঘন পরিবেশে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করে থাকেন। এতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান-শিক্ষকরা সহায়তা করে থাকেন। এ বিষয়ে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটিও অনুসরণ করা হচ্ছে।
এ বিষয় একই ধরনের বক্তব্য ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. নুরুল আলমের। তিনি বলেছেন, হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন আমরা সেটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। আরও অনেক আগেই র্যাগ ডের নামে এ ধরনের অপসংস্কৃতি বন্ধে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল। র্যাগ শিক্ষার্থীদের জন্য সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণ থাকবে। এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে, দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা করা হবে। দেশের বিভিন্ন বড় বড় শিল্পীদেরও এসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।
র্যাগ ডে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ কামরুল হাসানের রিট আবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি র্যাগ ডের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক ধরনের কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল ও ডিজে পার্টির স্থির চিত্র ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে।
যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক জীবন মান ও সুকুমার বৃত্তি সৃজনের কারিগর হওয়ার কথা সেখানে আজ সেই শিক্ষা প্রশাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাদের উপস্থিতিতে চরম নৈতিক অবক্ষয়মূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা নিজের অজান্তে নৈতিক অধঃপতনে নিমজ্জিত হচ্ছে।
আবেদনে বলা হয়েছে, যেহেতু দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ শিশু-কিশোর ও তরুণ এবং দেশের আগামী ভবিষ্যৎ, সেহেতু আমাদের আগামী প্রজন্মকে এ ধরনের অপসংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য র্যাগ ডে’র নামে অশ্লীলতা, ডিজে পার্টি ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়মূলক এসব কার্যক্রম সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধ করা প্রয়োজন।
রিট আবেদনের ফলে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা কার্যকর হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি ধরনের প্রভাব পড়বে- প্রশ্ন ছিল আইনজীবী মোহাম্মদ কামরুল হাসানের কাছে। তিনি বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার পরিবেশের পাশাপাশি আমরা সুস্থ বিনোদন চর্চার পক্ষে। কিন্তু সম্প্রতি এটির সীমা ছেড়ে গেছে। আগেও শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সমাপনী দিনে র্যাগ ডে’র আয়োজন করেছেন। সে ধরনের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে।
আরও পড়ুন: র্যাগ ডে’র নামে অশ্লীলতা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ
তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশীয় সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা শুরু হবে। অপসংস্কৃতি লোপ পাবে। এভাবে জুনিয়ররাও সিনিয়রদের আয়োজন থেকে শিক্ষা নেবে। হাইকোর্টের এ নির্দেশনা কারো কোন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মুক্তিবুদ্ধির চর্চা করবে এটাই স্বাভাবিক।
কৃষ্ণচূড়ার মিনহাজুলের মতে মহামান্য হাইকোর্ট পুরো র্যাগ ডে বন্ধের নির্দেশনা না দিয়ে বরং এটি উদযাপনে একটি সুনির্দিষ্ঠ কাঠামোর দিক-নির্দেশনা দিতে পারতো। এতে করে শিক্ষার্থীদের সাবলিল সাংস্কৃতিক চর্চায় কোন বাধা থাকতো না।
ছায়নটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেছেন, কোন বিষয়েই উচ্ছৃঙ্খলতার সুযোগ নেই। তবে আমার কাছে মনে হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগ ডে নিয়ে কোন আইনের প্রয়োজন নেই। দেশে তো অনেক আইন আছে; প্রয়োগ আছে কয়টার? তার থেকে শিক্ষার্থীদের কাজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে যেখানে সমস্যা সেখানের সমাধানে উদ্যোগ হওয়া প্রয়োজন ছিল।