জিয়া হলে দীর্ঘদিন ধরে মেস বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

চার মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের প্রিয় বন্ধন মেস।
চার মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের প্রিয় বন্ধন মেস।  © সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অন্যান্য সব হলের মেস খোলা থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের "বন্ধন" মেস অনেকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কেননা মেস থেকে স্বল্প মূল্যে ভাল খাবারের পরিবর্তে ক্যানটিন থেকে চড়া মূল্যের খাবার খেয়ে থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।

পূর্বে হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ম্যানার্ড না হওয়ার অজুহাতে মেসের সদস্য হতে পারতো না।  কিন্তু, জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষের নতুন নিয়ম অনুযায়ী তারা এখন মেসের সদস্য হতে পারবেন। সেখানে খাবার খেতে পারবেন।

আরও পড়ুন: সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জন্য বাংলাদেশকে ডিক্যাপ্রিওর অভিনন্দন

হল সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে নিযুক্ত হলের নতুন প্রাধ্যক্ষ মেসের কিছু নিয়ম পরিবর্তন করেন। নতুন নিয়ম অনুযায়ী এখানে এক সেশনের জন্য (১৫ দিন ) যে ম্যানেজার হিসেবে থাকবে তাকে কোন সম্মানী দেওয়া হবে না। তবে তার জন্য ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। যারা ম্যানেজার হবেন তারা এ কাজটিকে এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিজ এবং স্বেচ্ছাসেবা হিসেবে নিবেন। এদিকে, এ নিয়ম করার পর আর কেউ ম্যানেজার হতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা বলেন, এত সময় নষ্ট করে ও এত শ্রম দিয়ে নূন্যতম বিনিময় ছাড়া কেন এই চাপ নিবো?

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পূর্বে মেস পরিচালনা করতে ২ মাস বা এক সেশনের জন্য দুইজন শিক্ষার্থী ম্যানেজার হিসেবে থাকতেন। তারা বাজার করা থেকে শুরু করে খাবার প্রস্তুতসহ মেসের সবকিছুই দেখাশোনা করতেন। এজন্য তাদের অনেক শ্রম ও সময় ব্যয় হত। যার কারণে তাদেরকে মেসের সদস্য অনুপাতে মাসে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা করে সম্মানী এবং ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা করা হত।

এছাড়াও মেসে সদস্য সংকট থাকায় যারা অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেছে তারাও একসময় মেসে খেতে পারতো, এমনকি অন্যান্য হল থেকেও সদস্য নেয়া হত। তখন মেস ছিল জমজমাট এবং সবসময় ৩০০ এর অধিক সদস্যে ভরপুর থাকতো। কিন্তু নিয়ম-কানুনে পরিবর্তন আনায় মেসের অনেক সদস্য কমে যায়। এ নিয়মের পর সর্বশেষ সেশনে ৩০০ জনের মধ্য থেকে মাত্র ৯০ জন টাকা জমা দিয়েছিল। এজন্য তখন পর্যাপ্ত পরিমাণে সদস্য (অন্তত ২০০ জন সদস্য) না থাকায় মেস চালানো আর সম্ভব হয়নি এবং পরবর্তীতে ৯০ জনের টাকাই ফেরত দেয়া হয়। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের প্রিয় ‘বন্ধন’ মেস।

আরও পড়ুন: হল বন্ধ করা সমাধান নয়: ঢাবি ভিসি

মেস বন্ধ প্রসঙ্গে হলের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, "মেস বন্ধ হওয়ার কারণে আমাদের অনেক অসুবিধা হচ্ছে। আমরা মেসে যখন খেতাম তখন ১৪০০ টাকায় ২৩ দিন (দুই বেলা) খেতে পারতাম। এখন ক্যানটিনে খেতে আমাদের অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। টাকাও বেশি খরচ হচ্ছে, খাবারের মানও ভালো পাচ্ছিনা। অন্যদিকে মেসে খাবারের মান খুব ভাল ছিল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ছিল। সেই সঙ্গে সপ্তাহে ১ দিন স্পেশাল খাবারের ব্যবস্থাও ছিল। এখন আমরা এগুলো থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি।"

তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে আরও বলেন, "আমরা হলে যারা আছি তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। এই মুহূর্তে ১০ টাকা বাঁচলেও আমাদের ভাল হয়। এজন্য ক্যান্টিনের চড়া মূল্যের খাবার না খেয়ে খরচ বাঁচাতে অধিকাংশ সময়ই দিনে দুই বেলা ডিম দিয়ে ভাত খাই। সকালে ১০ টাকার নাস্তা করি, কখনো কখনো খাই-ই না। এভাবে ৬০/৭০ টাকার মধ্যেই তিন বেলা খাবার সম্পন্ন করি। কারণ, ভাল খাবার খেতে গেলেই প্রতিদিন ১১০ টাকারও বেশি খরচ হয়। এক্ষেত্রে মেসে খেতে পারলে আমাদের ভাল হত। কিন্তু মেস তো বন্ধ আছে।"

হলের আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, "মেস খোলার ব্যাপারে প্রাধ্যক্ষ স্যারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। তিনি চাইলেই চালু করতে পারেন। এতজন শিক্ষার্থীর কষ্টের কথা ভেবে হলেও স্যারকে নিয়মকানুনগুলো শিথিল করে ফের মেস চালু করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।"

আরও পড়ুন: আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো নেই: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

জিয়া হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, "মেস বন্ধ থাকা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর। কারণ, সব হলের মেস চালু রয়েছে শুধু আমাদের হলেই নেই। দোকান, ক্যানটিন বা অন্যান্য সব জায়গা থেকে মেসে তুলনামূলক ভালো খাবার ছিল। আমি চাচ্ছি খুব দ্রুত আবার মেস চালু হোক। আর আমাদের প্রভোস্ট যেসব নিয়মনীতি করেছেন সেগুলো যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে অবশ্যই ভালো হবে বলে আমি মনে করি। মেসের সবকিছুতে একটা স্বচ্ছতা থাকবে। আগে তো মেসে প্রথম বর্ষের ছাত্ররা খেতে পারত না। স্যারের নিয়মানুযায়ী ফার্স্ট ইয়ার থেকে শুরু করে বৈধ ছাত্র যারা রয়েছেন তারা সকলেই খেতে পারবেন, এ ব্যাপারটি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। তবে মেসে সদস্য না থাকার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তাই এ ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও দায়িত্ব নেয়া উচিত বলে মনে করছি।”

এদিকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, তিনি চান ছাত্রত্ব নেই এমন কেউ জিয়া হলের মেসে সদস্য না থাকুক এবং অন্যান্য হল থেকেও সদস্য না নেয়া হোক। কারণ, ঢাবির আর কোন হলের মেসে এরকমটা হয়না। পূর্বে জিয়া হলের মেসে ম্যানেজার হতে কেউ আগ্রহী না হওয়ায় ঘুরে-ফিরে অল্প কয়েকজনই দায়িত্ব পালন করেছেন, এবং তাদের বিরুদ্ধেও বেশ কিছু নেতিবাচক অভিযোগ রয়েছে। এসব বিবেচনা করে প্রাধ্যক্ষ চান যে, ১৫ দিনে একটি করে সেশন হোক, এ সেশনগুলোতে পর্যায়ক্রমে সকলেই ম্যানেজারের দায়িত্ব নিক। এতে ওই শিক্ষার্থীর লিডারশীপ কোয়ালিটি বৃদ্ধি পাবে, অনেক কিছু শিখতে পারবে। তাছাড়া তাদের জন্য ১৫ দিন ফ্রি খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

মেস চালু করতে প্রশাসন কি পদক্ষেপ নিচ্ছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাধ্যক্ষ বলেন, "আমার হলে চারটি ব্লক ভাগ করা আছে। আমার হাউস টিউটর যারা আছেন তাদেরকে নিয়ে ব্লকগুলোর প্রত্যেকটি রুমে গিয়ে ছাত্রদের সাথে কথা বলে বন্ধন মেসের জন্য সদস্য আহবান করছি।"

আরও পড়ুন: অনলাইনে ক্লাস চলবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

এসময় তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, "আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন প্রভোস্টের কাছে গিয়ে কথা বলে এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এসব মেস চালু করেছিলাম। আর এখন আমাকে প্রভোস্ট হয়ে মেসের সদস্য হতে ছাত্রদেরকে মোটিভেট করতে হচ্ছে।" এ ব্যাপারে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, "এটা কি প্রভোস্ট হিসেবে আমার দায়িত্ব? তারপরও ছাত্রদের ভালোর জন্য আমি এটা করছি।"

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের শেষের দিকে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে তার রেশ এসে পড়ে বাংলাদেশেও। এরপর  ২০২০ সালের মার্চে করোনার সংক্রমণ আতঙ্কের মধ্যেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা ভেবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের প্রিয় ‘বন্ধন’ মেস। তারপর দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর ২০২১ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খুলে দেওয়া হলেও আজ অবধি চালু হয়নি ‘বন্ধন’ মেস।


সর্বশেষ সংবাদ