ঢাবি ছাত্রীকে ফেসবুকে হেনস্তা, ভুক্তভোগী-অভিযুক্তের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ  © ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক ছাত্রের বিরুদ্ধে একই বিভাগের সহপাঠী এক ছাত্রীর সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে অশালীন আচরণ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ঘটনা ঘটেছে। গত ১০ জুলাই বিভাগের একটি অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতি দেয়াকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে।

এতে ওই ছাত্রী সহপাঠী ছাত্রের বিরুদ্ধে ‘সাইবার বুলিংয়ের শিকার ও এর প্রতিকার চেয়ে’ বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। তবে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী বলছেন, এটি দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি।

অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর নাম শিপন মিয়া। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয়-৭১ হলের আবাসিক ছাত্র ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র।

এ ঘটনায় ওই বিভাগ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভাগের অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন- বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা মিসেস সুরাইয়া আক্তার, ড. মো. সাইফুল্লাহ, বিভাগের শিক্ষক আব্দুর রহিম ও মাহমুদুর রহমান।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ওই ব্যাচের একটি শাখার নারী ক্লাস প্রতিনিধি। তিনি বলেন, আমি গত তিন বছর যাবত আমার সেকশনের ক্লাস প্রতিনিধি হিসেবে আছি। আমাদের সপ্তম সেমিস্টারের অনলাইন পরীক্ষা হবে বলে সেদিন (১০ জুলাই) ম্যাডাম অনলাইনে আমাদের রিভিউ ক্লাস নিচ্ছিলো। ক্লাসে উপস্থিতি নেওয়ার জন্য শিক্ষক ক্লাস প্রতিনিধিদের ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দেওয়ার কথা বলেন। যেখানে পোস্ট দেয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে শিক্ষার্থীরা মন্তব্যের ঘরে তাদের নাম, রোল লিখবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্লাস প্রতিনিধিরা সেই মন্তব্যের তালিকা শিক্ষকের কাছে প্রেরণ করবেন।

ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী বলেন, আমি ক্লাস প্রতিনিধি হিসেবে গ্রুপে উপস্থিতির জন্য পোস্ট করি। দুই সেকশন হওয়াতে ১০ মিনিটের জায়গায় ২১ মিনিট পর্যন্ত কমেন্ট সেকশন চালু রাখা হয়। এ সময়ের মধ্যেও অভিযুক্ত শিপন কমেন্ট করতে পারেনি।

ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে কেউ কমেন্ট করতে না পারলে সাধারণত আমাকে ফোন দিয়ে, ম্যাসেঞ্জারে বা অন্য কোনো ক্লাস প্রতিনিধিকে জানানো হয় উপস্থিতির জন্য। এরপরে ক্লাস প্রতিনিধিরা সেটি শিক্ষককে জানিয়ে দেয়।

‘‘কিন্তু অভিযুক্ত শিপন এর কোনটিই করেনি। উল্টো ব্যাচের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে সে আমাকে নিয়ে অকথ্য, নোংরা ভাষা ব্যবহার করে। ফ্যামিলি নিয়ে কথা বলে, খুবই বাজে ভাষায় কথা বলে। এসময় ভুক্তভোগীও অভিযুক্তের পরিবার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ম্যাসেন্জার গ্রুপে কথা কাটাকাটি হয়।’’

এতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তাদের কোর্স কো-অর্ডিনেটর, ছাত্র উপদেষ্টা দু’জন শিক্ষককে ফোন দিয়ে এ বিষয়ের অভিযোগ জানান। পরবর্তীতে বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন।

তবে অভিযুক্ত শিপন মিয়া সহপাঠীকে হেনস্থার বিষয়টি অস্বীকার করে বলছেন, আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে, আমি তাকে হেনস্থা করিনি, পরবর্তীতে বিষয়টির জন্য তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।

অভিযুক্ত শিপন বলছেন, সাধারণত ক্লাসের উপস্থিতি নেয়ার জন্য ক্লাস প্রতিনিধিরা ক্লাস শেষ হওয়ার পরপরই ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করে। কিন্তু সেদিন ক্লাস শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পরও এ সংক্রান্ত কোনো পোস্ট আমি খুঁজে পাইনি। পরবর্তীতে ১৫ মিনিট পরে আমি আবার ফেসবুকে ঢুকলে উপস্থিতি নেয়ার পোস্টটি দেখতে পাই। কিন্তু আমি কমেন্ট সেকশনে রোল দেয়ার আগমুহূর্তেই কমেন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়।

এতে পোস্টটির স্ক্রিনশট নিয়ে আমি ব্যাচের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে সেন্ড করি। তিনি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে লিখেন, নিয়মানুযায়ী উপস্থিতির জন্য ক্লাসের শেষে পোস্ট করার কথা, সেখানে ৫-৭ মিনিট আমি অপেক্ষা করেছি, কিন্তু তখন পোস্ট দেয়া হয়নি।

জবাবে অভিযোগকারী ক্লাস প্রতিনিধি লিখেন, পোস্ট দিতে কয়েক মিনিট দেরি হওয়াতে ২১ মিনিট পর্যন্ত কমেন্ট সেকশন অন রাখা হয়েছিল, নতুবা ১০ মিনিটে কমেন্ট সেকশন বন্ধ করে দিতাম।

তখন অভিযুক্ত শিপন অভিযোগকারীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ক্লাস শেষে পোস্ট করার কথা থাকলেও তুমি এ নিয়ম না মেনে নিজের মতো অন্য নিয়ম কেনো করেছো?’ এ নিয়ে ব্যাচের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে দুজনের মধ্যে বাকবিতন্ডা চলতে থাকে।

অভিযুক্ত শিপন বলেন, এক পর্যায়ে অভিযোগকারী আমার উদ্দেশে লিখেন, ‘আমি এমন ব্যবহার করে যেন আমার পরিবারের পরিচয় না দেই?’- এই কথা শুনে আমি অনেক আঘাত পেয়েছি। তখন আমিও জবাবে লিখি ‘আমার ফ্যামিলি তোমার ফ্যামিলির মতো এতো থার্ডক্লাশ না।’

সেসময় তাদের এক সহপাঠী তাদের উদ্দেশ্য লিখেন, ‘বন্ধুদের মধ্যে যেন কথা কাটাকাটি, বা কেউ কাউকে আক্রমণ করে কথা না বলি।’ এরপর অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দুজনেই চুপ হয়ে যায়।

অভিযুক্ত শিপন বলেন, আমি সেদিন কোভিড ভ্যাকসিন নিয়েছিলাম এবং অনেক ক্লান্ত ছিলাম। উপরের এই কনভারসেশনের পর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে শুনি সে (অভিযোগকারী) আমার বিরুদ্ধে বিভাগে অভিযোগ করেছে। তখন আমি তাকে ফোন দিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাই। আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে মাফ করে দিতে বলি।

এদিকে, এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর অভিযোগ, ‘আগের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভিযুক্ত শিপন এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের মেয়েদের একটি প্রাইভেট ফেসবুক গ্রুপে শিপন অনেকদিন ধরে গোপনে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর শিপনকে গ্রুপ থেকে ব্যান করা হয়। বিষয়টি আমি সেই গ্রুপের এডমিনদের জানিয়েছি এমন ধারণা থেকে আমার প্রতি শিপনের ক্ষোভ থেকে যায় বলে ভুক্তভোগীর অভিযোগ।

অন্যদিকে ভুক্তভোগীকে অশোভন ভাষায় গালি দেয়ার বিষযে অভিযুক্ত শিপন বলেন, আমাদের মধ্যে এ কথা কাটাকাটি হয়েছে ব্যাচের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে, যেখানে ব্যাচের সব বন্ধু-বান্ধব যুক্ত রয়েছে। সেখানে আমি কোনো অশোভন ভাষা ব্যবহার করিনি।

শিপন বলেন, সে আমাকে কটাক্ষ করে বলেছে আমার মতো শিপনরে সে গুনে না। আমিও সরাসরি না বলে স্টার দিয়ে বলেছি আমিও তাকে হিসাবে ধরি না। এখন স্টার দ্বারা যদি সে অন্য কিছু বুঝে তাহলে এটা আমি আসলে কি বলবো! সেখানে এমন কোনো শব্দ নেই যা দ্বারা প্রমাণ করতে পারবে যে আমি অপভাষা ব্যবহার করেছি।

মেয়েদের আবাসিক হলের প্রাইভেট গ্রুপে যুক্ত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি গ্রুপে যুক্ত ছিলাম এটা সত্য। তবে কিভাবে যুক্ত হয়েছিলাম সেটা আমিও জানি না। প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সাধারণত ফেসবুকের অনেক গ্রুপ থেকে ইনভাইট আসতো, হতে পারে কোনো বান্ধবী আমাকে ভুলে ইনভাইট দিয়েছিল, যেটা আমিও লক্ষ্য করিনি।

মেয়েদের প্রাইভেট গ্রুপে যুক্ত থাকার বিষয়টি নিয়ে অভিযোগকারীর প্রতি কোনো ক্ষোভ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেই ফেসবুক গ্রুপের এডমিনকে আমার যুক্ত থাকার বিষয়টি অভিযোগকারী জানিয়েছিলেন এটা আমি কয়েকদিন আগেও জানতাম না। এটা অনেক আগের ঘটনা। বিষয়টিকে অতিরঞ্জন করতে সে (অভিযোগকারী) এ বিষয়গুলোকে সামনে আনছে, গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে যা আমি এখন জানতে পারছি। কিন্তু তার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ ছিল না।

তদন্ত কমিটির উদ্দেশ্যে অভিযুক্ত শিপন বলেন, আমি অভিযুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই তদন্ত কমিটির শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ করবো, বিচারটা যেন একপাক্ষিক না হয়ে যায়। তারা যেন আন্তরিকতার সাথে বিষয়টি দেখেন, সুষ্ঠু তদন্ত করেন। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমাদের কারোরই মন ভালো নেই। আমাদের শিক্ষাজীবন থেকে আমরা দেড় বছরের মতো হারিয়ে ফেলেছি। আমি অভিযোগকারীর কাছে পুরো বিষয়টির জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছি।

এ বিষয়ে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য আমরা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। যথা শিগগিরই কমিটি প্রতিবেদন দেবে। সে আলোকে বিচার হবে।

তদন্ত কমিটিরর প্রধান ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, বৃহস্পতিবারে বিষয়টি আমাকে জানানো হয়েছে। বিষয়টির জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখবো এটার সত্যতা কতটুকু বা কি করা যায়। ঈদের আগে আপাতত মিটিং করা সম্ভব হচ্ছে না, ঈদের পরপরই আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. মো. আবদুর রহিম বলেন, বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নেয়া হয়েছে। আমাদের বিভাগের ঐতিহ্যের পরিপন্থী কোনো দৃষ্টান্ত যেন তৈরি না হয় সে বিষয়টি আমাদের নজরে থাকবে। বিভাগ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ