রাবিতে চার শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়েছেন একই প্রক্সিদাতা

মেহেদী হাসান সনি (বাঁয়ে ওপরে), ফাহিম আল মামুন বর্ণ (নিচে) ও মো. শোভন (বাঁয়ে দু’জনের পাশে) এবং চারটি অ্যাডমিট কার্ডে ব্যবহার করা একই ব্যক্তির ছবি (ডানে)
মেহেদী হাসান সনি (বাঁয়ে ওপরে), ফাহিম আল মামুন বর্ণ (নিচে) ও মো. শোভন (বাঁয়ে দু’জনের পাশে) এবং চারটি অ্যাডমিট কার্ডে ব্যবহার করা একই ব্যক্তির ছবি (ডানে)  © সংগৃহীত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে চার শিক্ষার্থীর ভর্তি করানোর অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে এর প্রমাণও মিলেছে। ৩ থেকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করে তারা ভর্তি হয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব শিক্ষার্থী পৃথক পৃথক বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। চার শিক্ষার্থীর হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসেছেন একই প্রক্সিদাতা। চারজনের অ্যাডমিটেও তার ছবি এডিট করে বসানো হয়েছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের বিশেষ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ চার শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনের বিভাগ সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। বাকি তিনজন হলেন- অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান সনি, আইন বিভাগের ফাহিম আল মামুন বর্ণ, ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শোভন। বর্ণ রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। শোভন রাবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ভাতিজা।

একই ব্যক্তির ছবিযুক্ত অ্যাডমিট কার্ডগুলোর সত্যতা নিশ্চিতের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফিসে। সেখানে একদিন সময় নিয়ে পরের দিন জানানো হয়, সবগুলো অ্যাডমিট কার্ড অরিজিনাল। এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যও এ প্রতিবেদককে সরবরাহ করেছে কর্তৃপক্ষ।

চারজনের অ্যাডমিটেই একই ব্যক্তি ছবি এডিট করে বসানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারও। তবে প্রক্সিদাতার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, প্রক্সির সহায়তায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে অন্তত ২০-২৫ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতেন ফোকলোর বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়।

তার ভাষ্য, ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার অন্তত ২-৩ মাস আগে থেকে চলত প্রস্তাব-প্রস্তুতি। প্রক্সির জন্য নিতেন শিক্ষার্থী প্রতি ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা। প্রক্সির গডফাদার হিসেবে খ্যাত এই তন্ময়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল রাবি প্রশাসন। পরে প্রক্সির সাথে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে গত বছরের ৪ অক্টোবর রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন বলে জানা গেছে। তার বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

চারজনের অ্যাডমিটেই একই ব্যক্তি ছবি এডিট করে বসানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টার। তবে প্রক্সিদাতার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, প্রক্সির সহায়তায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে অন্তত ২০-২৫ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতেন ফোকলোর বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দিনটি ছিল ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার তৃতীয় শিফটে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া অ্যাকাডেমিক ভবনের ৩১১ নম্বর রুমে মেহেদী হাসান সনির হয়ে প্রক্সি দিয়েছিলেন প্রক্সিদাতা। অ্যাডমিট কার্ডে নিখুঁত কারসাজির কৌশলে পরীক্ষার হলে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চোখ এড়াতে সক্ষম হন প্রক্সিদাতা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৭২ দশমিক ৬৫ নম্বর পেয়ে ১৬তম মেধাস্থান অর্জন করেন সনি। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০৩৩৩১৭০ এবং পরীক্ষার রোল নাম্বার ৯৬১১৫। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলায়। 

বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডের ছবির সাথে সনির নিজের চেহারার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। পরীক্ষার হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা যাতে প্রক্সির বিষয়টা বুঝতে না পারেন, সে জন্য সনির ছবির পরিবর্তে অ্যাডমিট কার্ডে সংযুক্ত করা হয় প্রক্সিদাতার ছবি। তাতে সফলও হন তারা।

এ বিষয়ে মেহেদী হাসান সনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি এসবের মধ্যে নেই। পড়াশোনা ও ক্যাম্পাস ছেড়ে একটি হোটেলে কাজ করছি। দুই বার ড্রপ আউট হয়ে আমি ক্যাম্পাস ছেড়েছি। তবে আমি ও ধরনের কিছু করিনি। সব ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। আগেও এসব নিয়ে কথা উঠেছিল।’ তবে পরে তার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চাইলে তিনি দিতে পারেননি। এ প্রতিবেদকের কাছে থাকা কাগজপত্র তাকে দিলে তিনি পরে আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেননি।

অন্যদিকে প্রক্সিদাতার সহযোগিতায় ফাহিম আল মামুন বর্ণ নামের এক শিক্ষার্থী ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৮২.৬০ স্কোর করে ৪৬তম মেধা স্থান অর্জন করে ভর্তি হন আইন বিভাগে। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০২১৬১২৬ এবং রোল নাম্বার ৫৪১৩৭। তার বাড়ি রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া উপজেলায়। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। তিনি রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

একই পন্থা অবলম্বন করে ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৭৯ দশমিক ৭০ নম্বর পেয়ে ২২তম মেধা স্থান অর্জন করেন মো. শোভন। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০৯২৯১১২ এবং রোল নাম্বার ৭১১০৬। বর্তমানে তিনি ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি রাজশাহীর মতিহার থানার বুধপাড়া গ্রামের মো. গোলাম সারওয়ারের ছেলে। তিনি রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ভাতিজা। তবে শোভনের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। 

অবাক করা ব্যাপার হলো, যে প্রক্সিদাতা সনির হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন; একই প্রক্সিদাতা বর্ণ ও শোভন ও মো. মিরাজুল ইসলাম শাওন (রোল ৭০৩৫৯) নামের এক শিক্ষার্থীর হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে মূল পরীক্ষার্থীর শরীরের গঠনের সেঙ্গে মিল রেখে অ্যাডমিট কার্ডে ছবি এডিট করা হয়েছে। কারো অ্যাডমিট কার্ডে এডিট করে ছবি মোটা করে দেওয়া হয়েছে। আবার কারও ক্ষেত্রে চিকন করে দেওয়া হয়েছে।

আরো পড়ুন: তবুও থামল না সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমরমা মাদকের কারবার

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বর্তমানে ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. এস. এম. এক্রাম উল্যাহ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ ঘটনাটা আমার সময়ের না। তবে ভর্তি পরীক্ষায় কেউ জালিয়াতি করলে কোনো প্রকার ছাড়া পাবে না। বিষয়টা তদন্ত হওয়া উচিত। এটা যদি সঠিক হয়, তাহলে উপাচার্য এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।’

শিক্ষার্থীদের অসদুপায় অবলম্বনের বিষয়টি প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী তাদের শাস্তি হবে বলে জানিয়েছেন ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সভাপতি অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যেকোনো কাজ করতে গেলে ত্রুটি বিচ্যুতি হতে পারে। সে সময় হয়তো তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন যেহেতু অভিযোগটা উঠেছে, তাহলে এটার তদন্ত করে প্রমাণিত হলে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।’

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অভিযোগটা যদি ডকুমেন্টেড ও প্রমাণিত হয়, তাহলে তাহলে আমাদের প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নেবেন। কোনো প্রকার নমনীয়তা বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতরে যাব না।


সর্বশেষ সংবাদ