ঢাবির হলে হলে হাঁটু পানি, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি চরমে
রাজধানীতে টানা বৃষ্টি
- জুবায়ের হোসাইন ও মুহাইমিনুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ০৭:১৭ PM , আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪, ০৮:৪৬ PM
আজ শুক্রবার ভোর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টা ভারী বৃষ্টি হওয়ায় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। টানা এই বৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস ও অধিকাংশ আবাসিক হলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
দুপুর ও বিকেলে সরেজমিনে ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে গিয়ে দেখা যায়, টানা কয়েক ঘণ্টা ভারী বৃষ্টির কারণে পানিতে ভেসে গেছে প্রতিটি হলের গেট, মাঠ, রিডিংরুম, ক্যান্টিন এমনকি নিচ তলার ফ্লোরও। তাছাড়া ক্যাম্পাসের একাধিক জায়গায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জলাবদ্ধতা নিরসনে তেমন কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য, নিচের ড্রেনেজ কন্ডিশন ভালো না হওয়াতে পানি সহজে বের হচ্ছে না। ফলে এই দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভারী বৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিসি চত্বর থেকে নীলক্ষেত রোড, শাহনেওয়াজ হোস্টেল, নিউমার্কেট, গণিত ভবন, কার্জন হল ও পলাশী এলাকা পানির নিচে চলে গেছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়টি আবাসিক হল পানির চলে গেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল এবং বঙ্গমাতা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল অন্যতম। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে মেয়েদের এই দুটি হলে।
এবার প্রথম নয়, এর আগে কয়েকবার পানি নিচে চলে গিয়েছিল মেয়েদের এ হল দুইটি। এবার মৈত্রী হলে পানি চলে গেছে নীচ তলার ১০৬ থেকে ১২০নং রুম, টিভি রুম, অডিটোরিয়াম এবং ক্যান্টিনেও। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হলটির শিক্ষার্থীরা।
সরজমিনের এ হলের আশেপাশে ঘুরে দেখা যায়, দুই হলের গেট থেকে শুরু করে পেছন পর্যন্ত কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি জমে গেছে। বন্ধ আছে ক্যান্টিনসহ অন্যান্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এই দুই হলের নারী শিক্ষার্থীরা।
কুয়েত মৈত্রী হল থেকে আজিমপুর যেতে জলাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে রিকশাচালকরা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।
মাস্টারদা সূর্য সেন হল তেমন জলাবদ্ধতা দেখা না গেলেও ভারি বৃষ্টিপাতে পাইপ দিয়ে পানি চুঁইয়ে রিডিংরুম এবং মসজিদের বেহাল দশা দেখা যায়। অনেকের বই খাতা পত্র ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।
হাজি মুহম্মদ মুহসীন হল, স্যার এফ রহমান হলের গেটে একই দৃশ্য দেখা যায়। তাছাড়া প্রবল বর্ষণে পানির নিচে চলে গেছে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল, রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হলের আশপাশ। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ যেন হাওড়-বাওড়ে রূপ নিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের নিচতলায় হাঁটুসমান পানি উঠেছে। ফলে রুম ছেড়ে শিক্ষার্থীরা অন্যত্র অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া পানি উঠায় হলের ক্যান্টিনে বন্ধ রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছে। রাতে বৃষ্টি হলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।
বিকেলে হলটির আবাসিক শিক্ষার্থী রাফি বলেন, হলের মাঠে বুক পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। এক্সটেনশন -২ এর নিচ তলার প্রতিটি রুমে পানি প্রবেশ করেছে। প্রায় একশ এর বেশি ছাত্র থাকে এখানে। ক্যান্টিনের ভেতর পানি চলে যাওয়ায় কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই। নিচতলার সকলে তিন তলার একটা ফাঁকা রুমে অবস্থান করছি। সকাল থেকে খাবার-দাবার থেকে শুরু করে সকল কিছুতে দুর্ভোগের মধ্যে আছি। আর কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলে পানি এক্সটেনশন-১ এ প্রবেশ করবে মনে হচ্ছে।
হলের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের হলের নিচতলার প্রত্যেকটি রুমের মধ্যে পানি প্রবেশ করেছে। বাইরে গলা সমান পানি। এ ব্যাপারে আমরা হল প্রভোস্ট স্যারকে সেই সকাল থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ফোন রিসিভ করছেন না। এই অনিয়ম ও অবহেলার শেষ কোথায়!
ওই হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. জাবেদ হোসেন বলেন, এবারের চেয়েও আগে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু এরকম জলাবদ্ধতা কখনও হয়নি। এবার শহীদুল্লাহ হলে যা হয়েছে তা নজিরবিহীন। আমার ধারণা পার্শ্ববর্তী যে সুয়ারেয়জ লাইন আছে সেগুলো কোনো কারণে ব্লক হয়ে আছে। সুয়ারেজ লাইনগুলোকে যদি নিয়মিত সংস্কার করা হত তাহলে এ সমস্যাটা হতো না।
তিনি বলেন, আমি রুমগুলো ভিজিট করে এসেছি। নীচতলার ক্যান্টিনেও পানি উঠেছে। অন্য ক্যান্টিন থেকে খাবার তৈরি করে ওদের সরবরাহ করা হচ্ছে। আর যাদের নিচতলায় ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে ওদের দোতালা টিভিরুমে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কুয়েত মৈত্রী হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, সকাল থেকেই ইলেক্ট্রিসিটি নেই৷ মোবাইলের চার্জও শেষের দিকে। হল থেকে যে বের হব সে পরিস্থিতিও নেই, রাস্তায় কোমর পর্যন্ত পানি। হলটির চতুর্থ বর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, হলের ভেতরে খুবই খারাপ অবস্থা। হলের লন পুরোটা ডুবে আছে। ক্যান্টিন ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ভেতরেও পানি ঢুকে গেছে। হলের সামনে থেকে শুরু করে ভেতর পর্যন্ত মোটামুটি কোমরপানি এখন। হলের নিচতলার রুমগুলোতে হাঁটুর কাছাকাছি পানি ছিল, এখন একটু কমেছে। বিদ্যুৎ নেই আবার বিশুদ্ধ পানির সংকট। সবারই খুব খারাপ অবস্থা। হল প্রশাসন এখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নাজমুন নাহার বলেন, হল এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। আমি নিজে এখানে আছি। মৈত্রী হলের নিচের ফ্লোরে ১০৬ থেকে ১১০ নাম্বার রুমে যেসব শিক্ষার্থী থাকে আমরা তাদেরকে উপরের ফ্লোরগুলোতে সরিয়ে নিয়েছি।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা বলেন, মৈত্রী হলের থেকে তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় একটু কম পানি হলেও আমাদের এখানেও বিদ্যুৎ নেই। বিশুদ্ধ পানির সংকট আছে। এই পানি কতক্ষণ এভাবে থাকবে আমরা জানি না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নিচতলায় যারা থাকেন তাদের। কিছু রুমে পানি ঢুকে গেছে।
পানিবন্দি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলও। পাশাপাশি শহীদ সার্জেন্ট জহরুল হক হলের মাঠেও কোমর সমান পানি রয়েছে। হলের প্রধান গেট ও সামনের রাস্তায় হাঁটুপানি। পলাশীতে হলের দ্বিতীয় গেটের সামনেও সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। হলের প্রাধ্যক্ষের ভবনেও পানি উঠেছে।
হলটির আবাসিক শিক্ষার্থী ফারুক মাহমুদ বলেন, হলের টিনশেডের অবস্থা খুবই খারাপ। আর বৃষ্টির পানির সাথে ড্রেনের পানি ও ময়লা পানি মিশে থাকায় পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আরেকটু বৃষ্টি হলে টিনশেড বিল্ডিংও পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
ক্যাম্পাসের জলাবদ্ধতার কয়েকটি ছবি দিয়ে মাহমুদ ইসলাম কাজল ফেসবুকে লিখেছেন, টাকা ও সময় সুযোগের অভাবে হাওড়-বাওড়ে যেতে না পারলেও আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম।
মাস্টারদা সূর্য সেন হলের প্রাধ্যাক্ষ অধ্যাপক অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন ভূইয়া বলেন, আজকে যে বৃষ্টি হয়েছে এটা অস্বাভাবিক, আমার হলে রিডিং রুম এবং মসজিদে পাইপের পানি চুইয়ে ভিজে গেছে অনেক শিক্ষার্থীর বই খাতা নষ্ট হয়েছে। রিডিং রুমের ছাদের ময়লা আবর্জনার জমে থাকার কারণে পানি বের হতে পারিনি। এর ফলস্বরূপ এমনটা হয়েছে।
ক্যাম্পাস ও হলে হলে পানি নিষ্কাশনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সকাল থেকেই আমরা পানি নিষ্কাশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের চেষ্টা করছি। পানি নিষ্কাশনের জন্য সকাল থেকেই সিটি করপোরেশনের লোকজন কাজ করছে। সমস্যা হচ্ছে নিচের ড্রেনেজ কন্ডিশন ভালো নয় ফলে পানি সহজে বের হচ্ছে না।
“সকালে যখন আমি প্রচন্ড বৃষ্টি দেখেছি, তখনই আমার গতবছরের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে পানি জমবে। ডাউনে যেসব মাইক্রো ড্রেনেজ আছে সেগুলো সব ব্লক অবস্থায় আছে। আমি সিটি করপোরেশনের সাথে যোগাযোগ করেছি, সকাল থেকেই তারা কাজ করছে— তাদের সবগুলো পাম্প চালু আছে৷ এখন পানি কিছুটা কমেছে কিন্তু যে হারে কমার কথা সেভাবে কমেনি।”