ইউজিসির অনিয়মের জেরে সরকারের গচ্চা কোটি কোটি টাকা

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন  © ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বিভিন্ন নিয়োগ অনিয়মের জেরে সরকারের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের আপত্তি সংক্রান্ত মেমোতে এ তথ্য উঠে এসেছে, যেখানে তিন ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ২৪ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ইউজিসিতে অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। অডিটে নিয়োগে অনিয়ম, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত অর্থ ঋণ হিসেবে নেওয়াসহ নানা বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে সংস্থাটি। আপত্তি জানিয়ে অডিট মেমো ইউজিসিতে জমাও দেওয়া হয়েছে।

অডিট মেমোর তথ্যানুযায়ী, ইউজিসির এক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও। নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালার পরিপন্থী এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারকে গত দুই অর্থ বছরে দিতে হয়েছে ৩০ লাখ ৬৯ হাজার টাকার বেশি। এছাড়া, তিন কর্মকর্তার নির্ধারিত বয়স না থাকলেও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। চাকরির নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে দেওয়া এই নিয়োগের ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। 

আরেকটি অনিয়মের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইউজিসির সাংগঠনিক কাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম) একটি পদ ৫ম গ্রেডে অনুমোদিত থাকলেও তা ১ম গ্রেডে উন্নীত করে বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে রাষ্ট্রের তহবিল থেকে। এই পাঁচ কর্মকর্তার পেছনে সব মিলিয়ে সরকারের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। 

তবে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সার্বিকভাবে ৪০ থেকে ৪৫ কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই অনিয়ম হয়েছে; যেখানে আর্থিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, অনিয়মের বিষয়ে অডিট আপত্তিতে ইতোমধ্যেই নিজেদের অবস্থান জানিয়ে উত্তর দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত অনিয়মের জেরে নেওয়া ওই কর্মকর্তাদেরকে অর্থ ফেরত দিতে হবে কিনা— এখন চলছে সেই হিসাব-নিকাশ।

ইউজিসির আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমন অনিয়ম শুধু রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির কারণই নয়, প্রশাসনিক দুর্বলতারও প্রতিচ্ছবি। ইউজিসি বলছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের চাপই অনেক সময় এমন সিদ্ধান্তে বাধ্য করে। এ বিষয়ে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিউটি খাতুন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ইউজিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা প্রাথমিকভাবে একটি প্রতিবেদন দিয়েছি। সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আলোচনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’

দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা ব্যক্তিকে নিয়োগে ক্ষতি ৩৫ লাখ
শিক্ষা অডিট দপ্তরের অডিট মেমোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০২২-২০২৩ হতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করে বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় সরকারের ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৮০২ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

বিস্তারিত নিরীক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নথি ও বেতন ভাতার বিল পর্যালোচনায় দেখা যায় ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান ভূঁইয়া অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টধারী (নং-চই ৪১৫৪৭৫৯) এবং তার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ লঙ্ঘন করে তাকে নিয়োগ প্রদান করে বেতন- ভাতা প্রদান করা হয়েছে। ফলে সরকারের ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৮০২ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়ে মাকসুদুর রহমানকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

অডিট মেমোর তথ্য বলছে, মাকসুদুর রহমান ভূঁইয়া ২০২২ সালের ৬ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বেতন-ভাতা বাবদ ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৭৪ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১৩ লাখ ১৯ হাজার ১২০ টাকা এবং ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯৩৮ টাকা নিয়েছেন।

সর্বোচ্চ বয়স অতিক্রম হওয়ার পরও তিনজনকে নিয়োগে ক্ষতি ২ কোটি ৭৯ লাখ
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এর ২০২২-২০২৩ হতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বয়স উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সংস্থাটির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জেসমিন পারভীন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সুরাইয়া ফারহানা এবং রিসার্চ গ্রান্টস এন্ড এওয়ার্ড ডিভিশনের সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় ২ কোটি ৭৯ লাখ ৪৯ হাজার ১৪৫ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

কমিশনের কর্মকর্তাগণের ব্যক্তিগত নথি, নিয়োগ সংক্রান্ত নথি এবং বেতন ভাতার বিল পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, কম্পিউটার অপারেটর পদে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ এবং পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর শাখা কর্মকর্তা স্থায়ী পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নয়ন নীতিমালা সংলগ্নী-১ এর লঙ্ঘন করে নিয়োগ প্রদান করা হয়। ফলে বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তিন কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

অডিট মেমোর তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জেসমিন পারভীন ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বেতন-ভাতা বাবদ এক কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ২৫০ টাকা নিয়েছেন। একই সময়কালে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সুরাইয়া ফারহানা এক কোটি ২ লাখ ৭৪ হাজার ১০৪ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া রিসার্চ গ্রান্টস এন্ড এওয়ার্ড ডিভিশনের সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামান ৪৬ লাখ ৩৪ হাজার ৭৯১ টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন।

অর্গানোগ্রামে ৫ম গ্রেড থাকলেও ১ম গ্রেডে বেতন দেওয়ায় ক্ষতি ৩৫ লাখ
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জানিয়েছে, কমিশনের ২০২২-২০২৩ হতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রেষণ নিয়োগ অর্গানোগ্রামে সংস্থাটির লিগ্যাল শাখার উপসচিব (জেলা ও দায়রা জজ) নুরুন্নাহার বেগম শিউলির বেতন ৫ম গ্রেড নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ১ম গ্রেডে বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় সরকারের ৩৫ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

বিস্তারিত নিরীক্ষায় ইউজিসি কর্মকর্তাগণের প্রেষণ সংক্রান্ত নথি এবং বেতন ভাতার বিল পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, অর্গানোগ্রামে ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে উল্লেখ আছে। কিন্তু ৫ম গ্রেডের পরিবর্তে ১ম প্রেডের কর্মকর্তাকে প্রেষণে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। বিমক অর্গানোগ্রাম লঙ্ঘন করে প্রেষণে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। ফলে সরকারের  আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট মেমোতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অতিরিক্ত পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ ব্যতিরেকেই পদোন্নতি/পদায়ন পেয়েছেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত পরিচালক মো. জিয়াউর রহমান ও উপপরিচালক শিবানন্দ শীল অভিজ্ঞতা ছাড়াই পদোন্নতি/পদায়ন পেয়েছেন।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!