মুখে মুখে আদেশ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দেন অধ্যাপক আলমগীর

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগী
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগী  © সংগৃহীত

‘‘ইউজিসির নির্দেশনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন হল ছাড়ার নির্দেশনা দেয়, তখন আমি ফার্মগেটে ছিলাম। দ্রুত হলে এসে ব্যাগ গুছিয়ে বের হলে কাঁটাবনের কাছাকাছি বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু ইউনুস আমাদের রিকশা থামিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই হাতে থাকা হকিস্টিক এবং দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করেন। আমিসহ কয়েকজন বন্ধু সেখানে ছিলাম, আমরা মারাত্মকভাবে আহত হই। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে অসংখ্য সাধারণ শিক্ষার্থী এদিন হতাহতের শিকার হন।”

এভাবেই নিজের আহত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী ইমরান উদ্দিন। তিনি জানান, মূলত গত ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলো বন্ধের নির্দেশনা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেটা বাস্তবায়নের কারণে শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে শুরু করেন। আর তখনই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা এ সময়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীর উপর হামলার সুযোগ পায়। কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এ ঘটনায় হতাহতের শিকার হন।

সচিব ড. ফেরদৌস জামান স্বাক্ষর করে প্রস্তাব অনুমোদন করা যায় মর্মে উপস্থাপন করেন ১০টা ৩০ মিনিটে। পরে ১০টা ৩৩ মিনিটে অধ্যাপক আলমগীর চিঠিটি অনুমোদন করেন এবং পত্র জারি করা হয় রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে। কিন্তু প্রথম চিঠিতে লম্বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে কোন প্রকার প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই পুনরায় আরেকটি চিঠি অনুমোদন করে পত্র জারি করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মোশাররিফ হোসেন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়  প্রশাসন বন্ধ ঘোষণার পরে আমরা হল ছাড়তে বাধ্য হই। তখন ছাত্রলীগের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন পয়েন্টে বাড়িমুখী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালানো হয়। আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় আন্দোলনে কেন গিয়েছি, আন্দোলনের সম্পৃক্ততা খুঁজতে সবার ফোন চেক করেন তারা। সেদিন তাদের হামলায় ঢাকায় অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আহত হন। 

আরও পড়ুন: ‘এখনই সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অর্ডার করতে হবে’— ১৬ জুলাই ইউজিসিকে নির্দেশ দেন নওফেল

কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইয়ামিন হাসানের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা দেয়ার পরেই মূলত ছাত্রলীগ মারমুখী আচরণ করতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে হামলার শিকার হয়। ছাত্রলীগ এবং পুলিশ আমাদের উপর সমন্বিতভাবে হামলা চালায়। অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল একটা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউজিসি কোন আইনের বলে বন্ধ করার নির্দেশনা দিতে পারে? এটা কতটা আইনসম্মত সিদ্ধান্ত?’

শিক্ষার্থীদের উপর হামলার দৃশ্য

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তখন গত ১৬ জুলাই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য কলেজসহ সকল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ এবং আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশনা দেয়। তবে নোটিশটি কিছুক্ষণ পরেই পরিবর্তন করে পুনরায় প্রকাশ করতে দেখা যায়।

অফিস টাইমের বাইরে তিনি একজন কর্মকর্তাকে নিয়ে এ ধরনের চিঠি ইস্যু করিয়েছেন। তিনি যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে ইউজিসির এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। সচিব হিসেবে আমার পরামর্শ দিলেও তিনি সেটা আমলে নেননি ড. ফেরদৌস জামান, ইউজিসির তৎকালীন সচিব

প্রায় ১৮ মিনিট পরে সংশোধিত নোটিশে ‘নির্দেশনা’র পরিবর্তে ‘অনুরোধ’ শব্দের ব্যবহার করতে দেখা যায়। ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান স্বাক্ষরিত আদেশে এমন পরিবর্তন এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ নিয়ে ইউজিসির নির্দেশনা কতটা বিধিসম্মত সেটি নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ইউজিসি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এমন নোটিশ শুধু বেআইনিই নয় বরং এর মাধ্যমে মূলত জুলাই গণহত্যার সূচনা হয়। 

আরও পড়ুন: ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় দখল গণস্বাস্থ্যের মেডিক্যাল কলেজ

গত ৫ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে সংঘাত–সহিংসতায় পর্যন্ত আহত হয়ে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। সরকার গঠিত কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে এ তথ্য এসেছে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আন্দোলনজুড়ে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে জুলাইয়ের ১৫ তারিখের পর। 

হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা

ইউজিসির বিভিন্ন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, চিঠি ইস্যুর বিষয়টি নিয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান সেদিন রাতে একাধিক কর্মকর্তাকে বল প্রয়োগ করেন। চিঠি ইস্যু সংক্রান্ত অফিস নথি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। যেখানে দেখা যায়, ইউজিসির প্রশাসন শাখার সহকারী সচিব কাজী মো: ইসমাইল হোসেন স্বাক্ষরিত নোটিশের অনুমোদন ও স্বাক্ষরের জন্য পেশ করা হয় রাত ১০টা ১৫ মিনিটে। এরপরে প্রশাসন শাখার উপসচিব মো. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত খসড়া অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয় রাত ১০টা ২৯ মিনিটে।

‘ওইত সরকারের নির্দেশনা থাকলে পারে।’ তিনি আরও জানান সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের নির্দেশে এই নোটিশ দেয়া হয়।। কিন্তু নোটিশ নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘ওইত সরকারের নির্দেশনা, এটা কোন লিখিত নির্দেশনা নয়।’ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর, ইউজিসির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান 

প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হলে সচিব ড. ফেরদৌস জামান স্বাক্ষর করে প্রস্তাব অনুমোদন করা যায় মর্মে উপস্থাপন করেন ১০টা ৩০ মিনিটে। পরে  ১০টা ৩৩ মিনিটে অধ্যাপক আলমগীর চিঠিটি অনুমোদন করেন এবং পত্রটি জারি করা হয় রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে। কিন্তু প্রথম চিঠিতে লম্বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে কোন প্রকার প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই পুনরায় আরেকটি চিঠি অনুমোদন করে পত্র জারি করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার এখতিয়ার ইউজিসির রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইউজিসির তৎকালীন সচিব ড. ফেরদৌস জামান জানান, এটা আসলে আমি জানি না। সেদিন আমাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক আলমগীর একাধিকবার কল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নোটিশ প্রস্তত করতে বলেন। এজন্য তিনি কয়েকবার কল দিয়ে তাড়াও দেন। আমি তখন হসপিটালে। প্রথমে সংযুক্ত হতে পারিনি। পরে জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশনা জারি করতে হবে। তখন বাধ্য হয়ে আমি শুধু নোটিশে স্বাক্ষর করেছিলাম। চিঠি প্রস্তত করেন সহকারী সচিব কাজী মো. ইসমাইল হোসেন।

আরও পড়ুন: নর্থ সাউথে স্বেচ্ছাচারী-দুর্নীতিপরায়ণ ট্রাস্টিদের পুনর্বাসন হচ্ছে?

সচিব হিসেবে নিজের দায়িত্বের বিষয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, আজকের প্রেক্ষাপট আর সেদিনের অবস্থা অনেক তফাত। এটা সম্পূর্ণ চেয়ারম্যানের দায়। কারণ মন্ত্রী ফোন দিয়েছে তাকে, অফিস টাইমের বাইরে তিনি একজন কর্মকর্তাকে নিয়ে এ ধরনের চিঠি ইস্যু করিয়েছেন। তিনি যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে ইউজিসির এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। সচিব হিসেবে আমার পরামর্শ দিলেও তিনি সেটা আমলে নেননি। 

ইউজিসি এমন নোটিশ কোনোভাবেই দিতে পারেন না। আপনি খেয়াল করবেন, এখানে কলেজগুলোও বন্ধের নির্দেশনা আছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। সে সময়ে সচিবের দায়িত্বে থাকা ফেরদৌস জামানও বিষয়টি বারণ করতে পারতেন। একজন সচিবের কাজ কি তাহলে? তারা সবাই একজন অপরজনের কথা বলছেন, তাহলে তাদের দায়িত্ব কী? -ইউজিসি কর্মকর্তা

একই সময়ে দুটি চিঠি ইস্যু হয়েছে এবং প্রথম চিঠিতে অফিসিয়াল ডেকোরাম ঠিক থাকলেও পরের চিঠিতে না থাকার কারণ জানতে চাইলে ফেরদৌস জামান জানান, চেয়ারম্যান হিসেবে সম্পূর্ণ বিষয়টি অধ্যাপক আলমগীর দেখভাল করেছেন। এখানে তিনি মন্ত্রী এমপিদের কথা বলেছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে, কিন্তু আমিও বলেছিলাম আমরা এটা দিতে পারি না। কিন্তু আমি দেখেছিলাম অনেকের কথা বললেও তিনি নিজেও বেশ আগ্রহী ছিলেন বিষয়টি নিয়ে।

ইউজিসি ভবন

ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইউজিসি এমন নোটিশ কোনোভাবেই দিতে পারেন না। আপনি খেয়াল করবেন, এখানে কলেজগুলোও বন্ধের নির্দেশনা আছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। সে সময়ে সচিবের দায়িত্বে থাকা ফেরদৌস জামানও বিষয়টি বারণ করতে পারতেন। একজন সচিবের কাজ কি তাহলে? তারা সবাই একজন অপরজনের কথা বলছেন, তাহলে তাদের দায়িত্ব কী?

কিন্তু এই আদেশের পরেই সারাদেশে শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে শুরু করে এবং তাদের উপর হামলা শুরু হয়। এখানে যত শিক্ষার্থী আহত নিহত হয়েছে, এটার দায় অধ্যাপক আলমগীর কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। তিনি সরকারি নির্দেশনার কথা বলেছেন, কিন্তু সরকারে কোন দপ্তরের নির্দেশনা ছিল? সেটার প্রমাণ কী? এসব বিষয়ে এড়িয়ে গেছেন। কোনোপ্রকার লিখিত নির্দেশনা ছাড়া সারাদেশে সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের মতো বড় সিদ্ধান্ত কি তিনি নিতে পারেন? এটা ত সরাসরি প্রতারণা। অধ্যাপক আলমগীরকে দ্রুত জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।

আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় সুশাসনের দায়িত্বে থেকে নিজেই নানা অপকর্মে জড়ান ড. সাজ্জাদ

তবে ইউজিসি কোন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলো বন্ধের নির্দেশনা দিতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ইউজিসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, সরকারের নির্দেশনা থাকলে ইউজিসি এমন নির্দেশনা দিতে পারে। তিনি আরও জানান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নির্দেশে ওই নোটিশ দেয়া হয়। এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘ওই তো সরকারের নির্দেশনা, এটা কোন লিখিত নির্দেশনা নয়।’

কারো মৌখিক নির্দেশনায় এমন সিদ্ধান্ত ইউজিসি নিতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আমার কিছু করার ছিল না।’ তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণায় আইনের ভিত্তি কী? সরকারের কোনো প্রকার ডকুমেন্টেড নির্দেশনা ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ কি? প্রথম নোটিশে নির্দেশ এবং পরের চিঠিতে অনুরোধ কেন? প্রথম চিঠিতে ইস্যু করার সব প্রক্রিয়া মানা হলেও পরের চিঠিতে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কেন শুধু চেয়ারম্যান অনুমোদন করেছেন এসব প্রশ্নগুলো রাখা হলে অধ্যাপক আলমগীর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। 


সর্বশেষ সংবাদ