মন্ত্রী-সচিবদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে ফোন

‘এখনই সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অর্ডার করতে হবে’— ১৬ জুলাই ইউজিসিকে নির্দেশ দেন নওফেল

মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং ইউজিসি লোগো
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং ইউজিসি লোগো  © সম্পাদিত

বিগত ৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর থেকে তা দমাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল তৎকালীন আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার। নানা কৌশল ও দমনপীড়নের পরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে না পারায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসতে থাকে সরকারের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে ধাপে ধাপে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিকের শিক্ষালয়গুলো বন্ধ করে সরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন শুরু হলেও তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এর মধ্যে সরকারি এবং বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। তখন আন্দোলন জোরালো এবং তা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক বেগবান হতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের প্রস্তুতি শুরু করে সরকার। 

‘‘কেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হবে—আমার এমন জিজ্ঞাসায় শিক্ষামন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন সরকারের নির্দেশনা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হবে এবং হল খালি করতে হবে। না হলে ব্যাপক প্রাণহানি হতে পারে’’— ইউজিসির চেয়ারম্যানকে বলেছিলেন নওফেল।

এরপর বিগত ১৬ জুলাই রাতে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা জারির জন্য ইউজিসিকে নির্দেশ দেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার রাত ৯ টার কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে টেলিফোন করেন তিনি।

টেলিফোনে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী জানান—তখন তার সাথে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, শিক্ষা সচিব সোলেমান খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে তিনি ইউজিসি চেয়ারম্যানকে কল করেন।

আরও পড়ুন: ছাত্রদল নেতাদের নেতৃত্বে ইউজিসিতে ‘ক্যু’, সচিবকে অপসারণ; ফেরানো হয়েছে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িতদেরও

টেলিফোনে নওফেল ইউজিসির চেয়ারম্যানকে বলেন, ‘একটা অর্ডার (নির্দেশ) আছে। এখনই করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করতে হবে। কালকে আশুরার ছুটি, আজকেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং হল খালি করার নির্দেশ দিতে হবে।’

‘‘আমার সাথে সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শিক্ষা সচিব রয়েছেন—আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলছি। আমাদের কাছে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না হলে শত শত লাশ পড়বে’’— ইউজিসি’র চেয়ারম্যানকে বলেছিলেন মহিবুল হাসান নওফেল।

আমি চেয়ারম্যান মহোদয়ের পক্ষ থেকে তিনটি কল পেয়েছিলার পরপর। আমি তখন হসপিটালে ছিলাম। প্রথম দু’টি কলে সংযুক্ত হতে পারিনি। শেষ ফোন কলে জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশনা জারি করতে হবে, সরকারের এমন নির্দেশনা রয়েছেড. ফেরদৌস জামান, তৎকালীন সচিব, ইউজিসি।

ইউজিসির কার্যাবলিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি বা অভ্যন্তরীণ কোনো সিদ্ধান্তের এখতিয়ার রাখা হয়নি। তবে সরকারের নির্দেশনা থাকলে তা করার সুযোগ পায় দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করতে হলে উচ্চশিক্ষালয়গুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে।

ইউজিসি অধ্যাদেশ ১৯৭৩ এর ধারা ৫ এর আই উপ-ধারা অনুযায়ী, আইন দ্বারা অথবা সরকার দ্বারা কোনো নির্দেশনা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের নির্দেশনা জারি করতে পারবে ইউজিসি। সে আইনের প্রতিপালনের আহ্বান জানিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অর্ডার জারি করতে হবে।

ইউজিসির বিগত ১৬ জুলাইয়ের নির্দেশনা। ছবি: ফাইল থেকে।

এরপর সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিন্ধের নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের ৫ এর আই ধারা অনুযায়ী সরকারের নির্দেশনা এবং জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা জারি করতে পারে সরকার। 

তখন রাত দশটার দিকে একটি এবং পরবর্তীতে রাত ১০টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি নির্দেশনা জারি করে ইউজিসি। ইউজিসির ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল—‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় দেশের সকল পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য কলেজসহ সকল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। একই সাথে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে নিরাপদ আবাসস্থলে অবস্থানের নির্দেশনা প্রদান করা হলো।’

আরও পড়ুন: সব সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা ইউজিসির

ইউজিসির এ নির্দেশনার আগেই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টি জরুরি একটি সিন্ডিকেট সভা করে তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কমিশনের নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের ঘোষণা আসতে থাকে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সিন্ডিকেটে জরুরি সভা ডেকে সরকারের আদেশ প্রতিপালন করে। একই সাথে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল থেকে শিক্ষার্থীদের চলে যেতে বাধ্য করে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীরের কাছে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি রাতে টেলিফোনে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়েছিলাম। তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অর্ডার জারি করতে বলেছিলেন। 

আরও পড়ুন: দেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ডজন খানেক সুপারিশ ইউজিসির

‘‘কেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হবে—আমার এমন জিজ্ঞাসায় শিক্ষামন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন সরকারের নির্দেশনা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হবে এবং হল খালি করতে হবে। না হলে শত শত লাশ পড়বে’’— ইউজিসির চেয়ারম্যানকে বলেছিলেন নওফেল।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, সরকার নির্দেশনা জারি করলে আমাদের নির্দেশনা মানতে হয়।

একই বিষয়ে জানতে কথা হয় ইউজিসির সাবেক সচিব ড. ফেরদৌস জামানের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি চেয়ারম্যান মহোদয়ের পক্ষ থেকে তিনটি কল পেয়েছিলার পরপর। আমি তখন হসপিটালে ছিলাম। প্রথম দুটি কলে সংযুক্ত হতে পারিনি। শেষ ফোন কলে জানতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশনা জারি করতে হবে, সরকারের এমন নির্দেশনা রয়েছে।

‘পরবর্তীতে আমাদের একজন সহকারী সচিব কমিশনে এসে চিঠিটি লিখে শিক্ষামন্ত্রীকে পাঠালে তাতে সংশোধন দেয়া হয়। এরপর তা সম্পন্ন হওয়ার পর  ভার্চুয়াল স্বাক্ষরে নোটিশটি জারি করা হয়েছিল। আমাদের তখন কিছু করার ছিল না’—বলেন ড. ফেরদৌস জামান।


সর্বশেষ সংবাদ