ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন চায়ের দেশ সিলেট
- ডি.এইচ.মান্না
- প্রকাশ: ০৫ মে ২০২২, ০৫:০১ PM , আপডেট: ০৫ মে ২০২২, ০৫:৪৪ PM
ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে। হয়তো সময়-সুযোগের অভাবে ইচ্ছে থাকা সত্যেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। প্রচলিত একটি উক্তি আছে যে, ভ্রমণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ভ্রমণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কর্মজীবনে একঘেয়েমি, কাজে আছে ক্লান্তি। এছাড়া শরীরের ক্লান্তি দূর করতে কাজের ফাঁকে একটু সময় তো আপনাকে বের করে নিতেই হবে। আপনি জানেন কি শরীর ও মনকে চাঙা করতে ভ্রমণের জুড়ি নেই।
ভ্রমণে যাওয়ার পূর্বে সর্বপ্রথম ঠিক করতে হয় গন্তব্য। আর তার ওপর নির্ভর করেই পরবর্তীতে নির্ধারিত হয় ভ্রমণের সময়, বাজেট, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। তবে আপনি যদি প্রকৃতি প্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার জন্য অপেক্ষায় প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য খ্যাত চায়ের দেশ সিলেট।
তুলনামূলক কম খরচে পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের নিয়ে এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি কাটান হযরত শাহজালাল, শাহপরান ও ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতিবিজড়িত করিম-হাছন, আরকুম আর রাধারমণের জন্মস্থান পূণ্যভূমি সিলেট।
সিলেট যারা ভ্রমণ করতে আসেন তাদের বেশির ভাগেরই প্রথম ইচ্ছে ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহ্জালাল (র.) ও হযরত শাহ্পরানের (র.) মাজার জিয়ারত করা। তাহলে এই ঈদের ছুটিতে তাদের মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে সূচনা হোক আপনার সিলেট ভ্রমণ।
ইট-পাথরের যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে হারিয়ে যান খানিক দূরে জল-ঝর্ণার মিতালীতে নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেনো আপন হাতজুড়ে সাজিয়েছে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো। সিলেটের প্রকৃতির রূপের রাণী খ্যাত জাফলং, পাথর স্পর্শ করে নেমে আসা স্বচ্ছ জলরাশির বিছানাকান্দি, পাহাড়ের বুক চিড়ে খেলা করা ‘মিনি নায়াগ্রা’ খ্যাত ঝর্ণা পান্থুমাই, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল।
তাও ভাল লাগছে না..? পা মাড়িয়ে আসুন শীতল পাটির চা বাগানের সবুজ গালিচায়। উঁচু-নিচু পাহাড়ের সরু পথ ধরে পাহাড়-টিলার পাদদেশ ঘুরে মন জুড়াবে যে কারোরই। নয়তো, নীল নদ খ্যাত লালাখাল কিংবা মিনি কক্সবাজার উপাধি পাওয়া হাকালুকির অথৈ জলরাশি মনকে করবে আন্দোলিত।
ট্রেনে কিংবা বাসে আসুন শহরে প্রবেশদ্বারেই সুরমার বুকে দেখতে পাবেন শতবর্ষী লোহার তৈরি ক্বীন ব্রিজ। ক্বীন ব্রিজের উত্তরপারে স্বাগত জানাবে আলী আমজদের ঘড়ি ও সার্কিট হাউস।
পর্যটন নগরী খ্যাত সিলেটে চোখ যে দিকে যাবে সেদিকেই আপনার মনে হবে এ যেন নয়নাভিরাম এক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তারপরও উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোর যাতায়াতের কথা উল্লেখ করা হলো- সিলেটের চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, পান্থুমাই- সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্রের এক সম্ভার সিলেট দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী।
সিলেটের লাক্কারতুরা চা বাগানে কিভাবে যাবেন
সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে বিমানবন্দর রোডে যে কোন ধরনের যানবাহন দ্বারা উল্লেখিত চা বাগানটিতে যাওয়া যায়। যে কোন গাড়ির চাকল কে লাক্কারতুরা চা বাগানের কথা বল্লে তারা আপনাকে নিয়ে যাবে।
জাফলং কিভাবে যাবেন
জাফলং সিলেট থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যেতে সময় লাগবে দেড় থেকে দু’ঘন্টা। সিলেট থেকে বাস বা মাইক্রোবাস অথবা সিএনজি করে যেতে পারেন জাফলং-এ। জাফলং যাওয়ার বাস ভাড়া জনপ্রতি ৯০ টাকা পড়বে এবং গেটলক বিরতিহীন বাস ভাড়া ১০০ টাকা।
আরও পড়ুন: সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘বঙ্গমাতা’র নামে করার সিদ্ধান্ত
আবার রিজার্ভ গাড়িতে যেতে চাইলে সিলেটের বন্দরবাজার শিশুপার্কের সামনে মাইক্রোবাস, সিএনজি বা লেগুনা পাওয়া যাবে। যাওয়া-আসার জন্য মাইক্রোবাস ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা। লেগুনা ভাড়া লাগবে ২০০০-২৫০০ টাকা। সিএনজি ভাড়া পড়বে ১০০০-১২০০ টাকা। লেগুনায় ১০ জন করে, সিএনজিতে ৫ জন করে আর মাইক্রোবাসে আসন অনুযায়ী বসে যেতে পারেন।
রাতারগুল কিভাবে যাবেন
সিলেট থেকে দুইভাবে রাতারগুল যাওয়া যায়। সিলেট শহরের পাশের খাদিম চা বাগান ও খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে খুব অল্প সময়ে রাতারগুল পৌঁছানো যায়। এই পথে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা জিপ নিয়ে শ্রীঙ্গি ব্রিজ যেতে হয়। সিলেট থেকে সকালে রাতারগুল গিয়ে বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসা যায়। তাই সারাদিনের জন্য সিএনজি কিংবা অটোরিকশার ভাড়া ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা লাগবে। সারাদিন সিএনজি ভাড়া নিলে একই ভাড়ায় বিছনাকান্দিও ঘুরে আসতে পারবেন।
যদি সিলেটের আম্বরখানা থেকে লোকাল সিএনজি চড়ে যেতে চান তবে শ্রীঙ্গি ব্রিজ পর্যন্ত যেতে জনপ্রতি ১০০ টাকা ভাড়া। শ্রীঙ্গি ব্রিজ থেকে রাতারগুল জলাবনে ঢুকার জন্য জেলেদের ছোট ছোট নৌকা পাবেন। একটি ছোট নৌকায় ৪-৬ জন চড়া যায়। এমন একটি নৌকার ভাড়া ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা। সিএনজি রিজার্ভ ও নৌকা ভাড়া করতে অবশ্যই দামাদামি করে নিন। রাতারগুলে লাইফ জ্যাকেট, ছাতা এবং মাঝির হ্যাট ভাড়া পাওয়া যায়।
রাতারগুল যাওয়ার দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে সিলেট হতে জাফলংগামী গাড়িতে গিয়ে সারিঘাট নামতে হবে। সিলেট থেকে সারিঘাট আসার ভাড়া নেবে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সারিঘাট হতে বেবিটেক্সিতে করে গোয়াইনঘাট বাজারে এসে নৌকা দিয়ে রাতারগুল যেতে হবে। আর ১০-১২ জনের জন্য একটি নৌকার সারাদিনের ভাড়া লাগবে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, তবে এ পথে খরচ এবং সময় বেশি লাগে।
এছাড়া সিলেটের বন্দর বাজার পয়েন্ট থেকে সিএনজি যোগে সাহেব বাজার হয়ে মটরঘাট পৌঁছে ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে রাতারগুল জলাবনে চলে যেতে পারবেন। মনে রাখা জরুরী যে পথেই রাতারগুল আসেন না কেন, বনের ভেতরে ঢুকতে গেলে জেলেদের ছোট নৌকা লাগবে।
লালাখাল কিভাবে যাবেন
সিলেট থেকে লালাখালের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। সিলেট শহর থেকে লালাখালে যেতে হলে প্রথমে নগরীর ধোপাদিধীর ওসমানী শিশু উদ্যানে বা শিশু পার্কের সামনে থেকে লেগুনা, মাইক্রোবাস বা জাফলংগামী বাসে চড়ে আপনাকে সারিঘাটে যেতে হবে। সারিঘাটে যেতে খরচ হবে ৪০-৬০ টাকা।
সারিঘাট থেকে লালাখালে দুই পথে যাওয়া যায় পানি পথে ও সড়ক পথে। সড়ক পথে যেতে হলে সারিঘাট ব্রিজ পার হয়ে উত্তর দিকে মসজিদ থেকে একটু এগিয়ে ডান দিকে লালাখালের রাস্তা পাওয়া যাবে। সেখানে দেখবেন সারি সারি অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। এসব অটোরিকশা দিয়ে আপনি লালাখাল পৌঁছে যাবেন। অটোরিকশা গুলো জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়া নেয়।
আর পানি পথে যেতে চাইলে সারিঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বা স্পিডবোটে যেতে পারেন। নৌকায় যেতে হলে ১২০০-১৫০০ টাকা খরচ হবে আর স্পিডবোটে গেলে ১৫০০-২০০০ টাকা খরচ হবে।
লালাখালের নীল, নীলচে সবুজ ও আকাশি নীল রঙের জলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌকা ভাড়া করে নিতে পারেন। এখানের রঙিন ছাউনি নৌকা ভাড়া করতে লাগবে ৫০০-৭০০ টাকা। আর ছাউনি বিহীন নৌকা ৩০০-৪০০ টাকায় ইচ্ছেমত সময়ের জন্য ভাড়া নিতে পারেন।
হাকালুকি হাওর (ফেঞ্চুগঞ্জ জিরো পয়েন্ট) কিভাবে যাবেন
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি দূরে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। সিলেট হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে বাস, সিএনজি অথবা লেগুনা করে মাইজগাঁও বাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে পুনরায় সিএনজি যোগে ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্টে গেলেই হাকালুকি হাওর ভ্রমণ করা যাবে। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকার মত খরচ হবে।
ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর কিভাবে যাবেন
সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। দেশের যেখান থেকেই ভোলাগঞ্জ যেতে চান আপনাকে প্রথমে সিলেট শহরে আসতে হবে। সিলেটের আম্বরখানা থেকে সাদাপাথর পরিবহনে করে নৌকা ঘাট পর্যন্ত যাওয়া যায় এবং বিআরটিসি বাস, বাস, সিএনজি, লেগুনা বা প্রাইভেট কারে করে যাওয়া যায় ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরে।
বিছনাকান্দি কিভাবে যাবেন
সিলেটের ওসমানী শিশু পার্কের সামনে কিংবা আম্বরখানার সামনে থেকে গোয়াইনঘাটগামী- সিএনজি, লেগুনা ও অটোরিকশা পাওয়া যায়। ভাড়া ৯০- ১৩০ টাকা। তারপর গােয়াইনঘাট থেকে হাদারপার বাজার | যেতে হবে সিএনজি কিংবা অটরিকশা করে। এতে ভাড়া নেবে ৪০-৬০ টাকা। এরপর হাদারপার থেকে নৌকা নিয়ে যেতে হবে বিছানাকান্দিতে।
পান্থুমাই কিভাবে যাবেন
সিলেট থেকে পান্থুমাই যেতে হলে সর্বপ্রথম আপনাকে সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট যেতে হবে। সেখানে বিমানবন্দর রোডের দিকে সিএনজি স্টেশন আছে। সিএনজি রিজার্ভ করে হাদারপার নামক জায়গা পর্যন্ত গেলে ভালো হয়। হাদারপার বাজারটি খুব একটা বড় না আবার ছোটও না। মোটামুটি সবকিছুই পাবেন। খাবার, পানি, কাপড় সবই কিনতে পাওয়া যায়। হাদারপার বাজারেই বিছানাকান্দি/পান্থুমাই যাওয়ার নৌকা পাওয়া যায়।
তাই এই ঈদের ছুটিতে সবান্ধব কিংবা সপরিবারে চলে আসুন প্রকৃতি কন্যা সিলেটে। ঈদের অবকাশ যাপনে পর্যটনে সিলেট হতে পারে আপনার পছন্দের অন্যতম। তবে, বিভিন্ন সময়, উপলক্ষ ও যানবাহন ভেদে ভাড়ার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। সবার জন্য শুভকামনা।